রাজু আহমেদ অভিনেতা এবং চিত্র  শিল্পী
রাজু আহমেদ অভিনেতা এবং চিত্র শিল্পী

রাজু আহমেদ (জন্মঃ- ১৯৩৯ - মৃত্যুঃ- ১১ই ডিসেম্বর ১৯৭২ ইং) ২৮ বৈশাখ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শুধু একজন শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে অনবদ্য ভূমিকাও রেখেছিলেন অন্যদিকে ছিলেন একজন চিত্র শিল্পী।

নাটক পাগল রাজু অল্প সময়ের মধ্যে যোগ্য অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী রাজুকে জীবনের তাগিদে বাস করতে হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্থানে। ষাট দশকের সিনেমার জনপ্রিয় এ খলনায়ক পাকিস্থানের করাচিতে মাসুদ খান নাম নিয়ে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেন। করাচি অবস্থানকালে বাঙলিদের নিয়ে সেখানেও বাঙলা নাটক মঞ্চায়ন করে সবার দৃষ্টি কাড়েন তিনি। করাচি থেকে ফিরে আবার কুষ্টিয়ায়। পেশা বলতে জীবন বীমার চাকরি আর নেশা নাটক।

সে সময় মঞ্চে রাজু আহমেদের অভিনয় এমনই প্রভাব ফেলতো, নাটক দেখে তার বাচণভঙ্গি দর্শকরা অনুকরণ করতো। রাজ্জাক কবরীর তখন রমরমা বাজার। সেই মুহুত্বেই বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে ব্যাতিক্রমধর্মী এ খলনায়কের। এরপর ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার পর আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু। দর্শক নন্দিত এ অভিনয় শিল্পী শুধু সিনেমাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, একই সাথে বেতার, টেলিভিশনেও ছিল তার সমান আধিপত্য।

টেলিভিশনে কাজী নজরুল ইসলামের রাক্ষুসী নাটকে তার অভিনয় পরবর্তী সময়ে আর কারো পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। শুধু মনে প্রাণে অভিনেতাই নয় ভালো মানুষ বলতে যায় বোঝায় তার সব গুণই ছিল রাজু আহমেদের ভিতর। বাংলা চলচ্চিত্রের গর্ব রাজুকে ছুঁতে পারেনি কোন অহংকার।

রাজু আহমেদ নিজ প্রতিভাগুণে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজু আহমেদ ছিলেন রণাঙ্গনের শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত নাটক ‘জল্লাদের দরবারে’ জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এই নাটকে তার ভরাট কণ্ঠ সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর শক্তি জুগিয়েছিল। রাজু আহমেদের বাবা খন্দকার লুৎফল হক ছিলেন একজন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী, আইনজীবী ও নাট্যব্যক্তিত্ব। মা রত্নগর্ভা। তার ভাই-বোন সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

অনন্য প্রতিভার অধিকারী রাজু আহমেদ মুক্ত স্বাধীন দেশে তার অভিনীত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জল্লাদের দরবার চলচ্চিত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় এটির মহরত অনুষ্ঠান ও হয়েছিল এফডিসিতে। ওই চলচ্চিত্রে কাজ করার অনুরোধ জানাতে শিউলি আহমেদের বাসায় যান তারা। সাথে পরিচালক কল্যাণমিত্র। কথাবার্তা শেষ করে রাত ৮টার দিকে বাসায় ফিরছিলেন। কিন্তু আগে থেকেই ওই স্থানে অস্ত্র নিয়ে ওতপেতে ছিলেন স্থানীয় বাবলা ও প্যারোটসহ আরও কয়েকজন। রাজু আহমেদকে দেখেই তাদের হাতের অস্ত্রগুলো তেঁতে ওঠে। ব্রাসফায়ার। গুলিবিদ্ধ হন রাজু আহমেদ, কল্যাণমিত্র এবং তাদের রিকশাচালকও। ১৯৭২ সালের ১১ ডিসেম্বর মানুষরূপী হায়েনাদের তপ্ত বুলেটে ৩৩ বছর বয়সী টগবগে এই যুবকের শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু সময় পরই তার মৃত্যু ঘটে। অপরদিকে হাতে গুলিবিদ্ধ কল্যাণ মিত্র প্রাণে বেঁচে যান। গুলিবিদ্ধ রিকশাচালককে নিয়ে কল্যাণ মিত্র হাসপাতালে যেতে সক্ষম হন। অস্ত্রধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ঘটনা ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। কুষ্টিয়া মুসলিম স্কুলের মাঠে জানাজা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর। এতে কুষ্টিয়ার হাজার হাজার মানুষ শরীক হন। পরে তাঁকে দাফন করা হয় তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে।

নাটক পাগল অভিনেতার মৃত্যুটাও যেন নাটকীয় ভাবে সংঘটিত হয়। লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষ হতবাক। দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে সংস্কৃতি অঙ্গণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এ হত্যাকাণ্ডটি মানুষকে ব্যাপক নাড়া দেয়।

সেদিন রাত আনুমানিক ১০টায় রাজু আহমেদের অনুজ বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব আমিনুল হক বাদশা নিজেই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর বাসায়। ওদিকে ঘটনা ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

রাজু আহমেদ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু গাফিলতির কারণে তদন্ত এগোয় না। রাজু হত্যার বিচার পান না তার স্বজনরা। পরবর্তীতে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। খান মজলিশ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। জিয়া সরকার আমলে মার্শাল ল চলাকালে গ্রেফতার হন খুনি বাবলা ও প্যারোট। মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর জেল খেটে তারা বেরিয়ে যান। রাজু আহমেদের ভাই বলেন, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে জল্লাদের দরবারের মূল ভূমিকায় জল্লাদের চরিত্রে অভিনয় করে ইয়াহিয়ার মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন, তার মৃত্যুরই বিচার হলো না।

রাজুর খুনিদের বিচার হয়নি। রাজুকে হত্যার পর একই ঘাতকরা খুন করে অভিনেত্রী শিউলি আহমেদকে। ১৯৭৩ সালে অস্ত্রধারীরা শিউলি আহমেদকে গুলি করে হত্যার পর এসিড ঢেলে দিয়েছিল শরীরে। পর পর এই দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মনে করতেই এখনো শিউরে ওঠে মানুষ।

আমাদের দুর্ভাগ্য রাজু আহমেদ খুব অল্প বয়সে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হন। রাজু আহমদেকে আমরা হারালাম যখন সে অভিনেতা হিসেবে তার ক্ষমতার সর্ব উচ্চ শিখরে উঠার হদিস খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তার ওপর আরোহনও শুরু করেছিলেন

রাজু আহমেদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিঃ-

  • বাল্যবন্ধু
  • পদ্মা নদীর মাঝি
  • মিশর কুমারী
  • কাঁচ কাটা হীরে
  • স্মৃতিটুকু থাক
  • আমার জন্মভূমি
  • কাঁচের স্বর্গ
  • অশান্ত ঢেউ
  • দুটি মন দুটি আশা

তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন চিত্র শিল্পীও। ছবি আঁকতেন রাজু। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে করাচিতে অনুষ্ঠিত চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তার আঁকা একটি ছবি পুরস্কৃত হয়। রাজু নিহত হওয়ার পর তার কণ্ঠের অসমাপ্ত ডাবিংগুলো দারাশিকোর কণ্ঠ দিয়ে পূরণ করা হয়েছিল।

ভয়াল নিকষ কালো অন্ধকারে হিংসাত্নক পৃথিবীর শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে যান রাজু আহমেদ। রেখে যান শিল্প-সংস্কৃতির পথে তার বলিষ্ঠ উজ্জ্বল পদচিহ্ন। অভিনেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা রাজু আহমেদকে আজ আমরা ভুলে গেছি। বেঁচে থাকার স্বাভাবিক টানাপোড়নে জীবিকা নির্বাহের প্রাত্যহিক তালিকায় রাজু আহমেদ আজ অনুপস্থিত। তবু বিশেষ বিশেষ সময়ে বা দিনে তাঁর স্মৃতি আমাদের পীড়িত না করে পারে না।

প্রখ্যাত অভিনেতা রাজু আহমেদ আজও মরণোত্তর কোন পুরস্কার পাননি। সরকারি কোন সাহায্য ও রাজুর পরিবারের জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। রাজু আহমেদের স্ত্রী তার তিনটি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একাকী সংগ্রাম করে গেছেন আজ তিনিও মৃত। রাজু আহমেদ হারিয়ে যাননি। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন আজীবন বাঙালির হৃদয়ে।

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য