আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

পাঞ্জু রচনায় আধুনিকতা
পাঞ্জু রচনায় আধুনিকতা

সাহিত্যে আধুনিকতা বলতে সাম্প্রতিক রচিত, পূর্ব যুগের সৃষ্ট থেকে আলাদা, নতুন আবেদনে ভরপুর এবং সমসাময়িক কালের ভাবনায় উদ্দীপ্ত সৃজনশীল রচনাবলীর যথার্থ প্রকৃতিকে বুঝায়। এই প্রকৃতি বিচারে ‘সাহিত্যকে আধুনিক অভিধায় চিহ্নিত করা যায় তখন, যখন কোন অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের প্রকাশে সে সাহিত্য পূর্ব যুগের সাহিত্য থেকে পৃথক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সাহিত্যের মেজাজ এবং স্বাদ যেমন নতুন, তেমনী সমসাময়িক যুগ-প্রবৃত্তির পরিচয় ওঠে সেখানে প্রকট হয়ে।’

এসব বিষয় বিবেচনা করলে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, অতীতপ্রীতির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী মিলিত হয়ে বিগত ও বর্তমান শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে পূর্ব যুগের সাহিত্য-ধারা থেকে সম্পূর্ণ নতুন প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইংরেজী শিক্ষা, ইংরেজী সাহিত্য, ইংরেজ প্রবর্তিত রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি মিলিয়ে এ নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেন- ‘সাহিত্যে আধুনিকতার পথ আবিস্কৃত হইতে লাগিল, ইংরেজী শিক্ষা ও তজ্জনিত নব-মানসিকতা সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে। রঙ্গলাল-মধুসূদন-ভূদেব-বঙ্কিমের রচনাকে সম্ভাবিত করিয়াছিল ইংরেজী শিক্ষা। ইংরেজী সাহিত্যের রস গ্রহণ করিয়া শিক্ষিত বাঙালী চিত্তে যে আত্নসম্মান, দেশপ্রীতি ও বিস্মায়বোধ জাগ্রত হইল, তাহাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রেরণার মূলে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল মোটামুটি তিনটি ধারায়। প্রথমত চলতি সাহিত্যে ভাব-পরিবর্তন। এই ভাব পরিবর্তনের নিদর্শন পাওয়া যায়-আধ্যাত্ন সঙ্গীত ও প্রণয় সঙ্গীতে, নীতিমূলক কবিতায়, সামাজিক রীতি অথবা ঘটনা বিষয়ক ছড়ায় ও কবিতায়। দ্বিতীয়ত, ইংরেজী গদ্য ও পদ্য আখ্যায়িকার এবং কাব্যের অনুবাদ ও অনুসরণ। তৃতীয়ত, ইংরেজী আখ্যায়িকা কাব্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত বীরত্ববোধক ও দেশ-প্রেমোদ্দীপক রোমান্টিক কাহিনী-কাব্য।

এখানে আরো উল্লেখ করা যায় যে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই (১৮০০ থেকে ১৮৬০ খ্রীঃ পর্যন্ত ধরা যায়) পদ্য ও গদ্য উভয় ক্ষেত্রেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। তবে এই প্রতিষ্ঠা পর্বে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের অবদান অতি নগন্য। ইংরেজী শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের বিরুপ মনোভাবাই এর মূল কারণ। এমন কি সিপাহী বিপ্লবের পরে আধুনিক বাংলা সাহিত্য চর্চায় আত্ননিয়োগ করা সত্ত্বেও মুসলমান সাহিত্যিকদের সাধু বাংলা ভাষার মাধ্যমে সাহিত্য চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমান পাঠকদের পুথি ব্যতীত কোন সাহিত্য পাঠের আগ্রহ তখনও জন্মেনি। অন্যদিকে ধর্মীয় অনাচার ও সামাজিক অবক্ষয় তাদেরকে বিদ্যাচর্চার মনোভাব থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। অজস্র প্রতিবন্ধকতায় সর্বহারা হয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় তাদের দিন কাটছিল।

এমনি ধরণের একটি বদ্ধ পরিবেশে পাঞ্জু শাহের আবির্ভাব। ইংরেজী শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং সামাজিক রক্ষণশীলতার দরুন আধুনিক পদ্য কিংবা গদ্য সাহিত্য চর্চায় তিনি আত্ননিয়োগ করতে পারেননি। শিক্ষা বিস্তার, রাজনীতি প্রচার ইত্যাদি কোন কাজেই তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণের স্পৃহা ছিল না। কেবল মানুষকে পারলৌকিক মঙ্গল-পথে যাত্রার অনুপ্রেরণা দানের একটি কঠিন মনোভাব ছিল তার। এই মনোভাব থেকে সৃষ্ট কবি-দৃষ্টিসদ্ভূত সাহিত্য সাধনার ভিত্তিতে তিনি নশ্বর এ জীবণকে অবিনশ্বর চিরন্তন জগতে প্রতিষ্ঠিত করার কর্ম-প্রনালী লিপিবদ্ধ করেছেন। পাঞ্জু-সাহিত্য তাই একটি আধ্যতœ জীবণ সাধনার বাণী সংকলন। ‘বাণী’ সাধারণত চিরন্তন বাক্য, যার মধ্যে সাহিত্য আশ্রয় গ্রহণ করে, কতকগুলো ধর্মোপদেশ মাত্র নয়। কাব্য-সৌন্দর্যের আধারে পাঞ্জুর বাণী সাহিত্য আকারেই প্রকাশিত এবং সে সাহিত্য আধুনিক সাহিত্যের পূর্ণ বিকাশের কালে সৃষ্ট। যুগের প্রভাব, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া এবং দেশ কালের গন্ডী ছাড়িয়ে আবার কোন সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। একারণে কবির জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে পাঞ্জু-সাহিত্যে আধুনিকতা অতি স্বাভাবিকভাবেই এসে গেছে। তাঁর রচনাবলী পর্যালোচনা করলে একথার সত্যতা জানা যাবে।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা সৃষ্টির যে তিনটি ধারার উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রথমটি পাজ্ঞু সাহিত্যে কার্যকর দেখা যায়। ‘ইস্কি-ছাদেকী গওহোর’ কাব্যে ‘মেছেলে কাঠুরিয়ার কিচ্ছা’ একটি নীতিমূলক কবিতা। তবে কবিতায় বর্ণিত কাহিনী পাঠ করলে এতে আধুনিক ছোট গল্পের স্বাদ পাওয়া যায়। কাঠুরিয়ার স্ত্রীর প্রতি গ্রাম্য মোড়লের লোলুপ দৃষ্টি, দুদ্ধের বিনিময়ে মোড়লের লালসা চরিতার্থ করার উদগ্র বাসনা, স্ত্রীর প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে কাঠুরিয়ার দুঃসাহসিক অভিযান, দ্ধিধাদ্বন্দ্বের উর্দ্ধে উঠে কঠিন বাস্তবকে মেনে নেয়ার মানসিক শক্তিতে কাঠুরিয়া-স্ত্রীর সুদূঢ় পদক্ষেপ, কাঠুরিয়া দম্পতির অসাধারণ ত্যাগতিতিক্ষার কাছে মোড়লের মানস পরিবর্তন, মানবতার মূল্যবোধ সম্পর্কে চেতনা ইত্যাদি মিলে কিচ্ছাটিকে ছোট গল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একটি আধুনিক চেতনাবোধ এখানে বেশ ক্রিয়াশীল দেখা যায়।

বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও যুক্তিনিষ্ঠ পর্যালোচনা আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানব-জীবণ, মানব-সমাজ, শাস্ত্রবাণী ইত্যাদি কিছুই বিচার বিশ্লেষণের আওতা থেকে বাদ যায় না। আধ্যাতœবাদের কবি হলেও এই যুক্তিবাদী মনোভাব পাঞ্জুর কাব্যে বিদ্যমান ছিল। তাঁর কাব্যে উল্লেখিত ‘ইব্রাহীম খলিলোল্লা কোরবাণী দেন তাহার বয়ান’ শীর্ষক কবিতায় কুরআন-বর্ণিত কাহিনী পয়ার ছন্দে বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে কবি তাঁর যুক্তিবাদী মনের কথা অকপটে বলে গেছেন। হযরত ইব্রাহীম বহু সংখ্যক পশু কোরবাণী দেন, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তা গৃহীত হয় না। এতে কবির মনে প্রশ্ন জেগেছে-‘যে পশু কোরবাণী আল্লাহ গ্রহণ করেননি, সেই পশু কোরবাণী দিয়ে আমরা কেমন করে পুলছেরাত পার হবো?’ আল্লাহ তো পশু কোরবাণী চাননি, তিনি চেয়েছেন ইব্রাহীমের সবচেয়ে প্রিয়বস্তু। ইব্রাহীমও তাঁর পুত্রকে প্রিয়বস্তু জ্ঞানে কোরবাণী দেন। কবি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পুত্র নয়, বরং নিজের প্রাণই সর্বাধিক প্রিয়বস্তু। তাঁর ভাষায়-

‘বড় ভালবাসা সেই বেটাকে জানিল।
বড় ভালবাসা বেটা কেমনে হইল।।
জানের উপরে ভাল নাহি দেখা যায়।
নাহি বুঝে, কোরবাণী বেটা দিতে চায়।।’

 

অন্ধ-বিশ্বাসে পশুর রক্তপাত ঘটালে কোরবাণী হয় না। পশুর রক্ত ও মাংস বিশ্ব স্রষ্টার দরবারে পৌছায় না, তিনি দেখেন মানুষের ঈমান। স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, কবির মনের কথাগুলো স্পষ্টতঃই অত্যন্ত জোরালোভাবে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। ধর্মীয় বিধি-বিধান পর্যন্ত পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ, আধুনিক বিজ্ঞান-সম্মত যুক্তিযুক্ত মতামত উপস্থাপন এবং বাস্তববাদী বক্তব্য পেশ করার মানসিক প্রস্তুতি পাজ্ঞু শাহকে পুথির শায়ের থেকে আধুনিক মহৎ-কাব্য-স্রষ্টার পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

জীবন-যন্ত্রনার করুণ চিত্র যথাযথখাবে ফুটিয়ে তোলা আধুনিক সাহিত্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সমস্যায় মানুষ আজ বিপর্যস্ত। দৈনন্দিন এই জীবন-জিজ্ঞাসা পাঞ্জু সাহিত্যে অনুপস্থিত নয়। তাঁর কাব্যে আছে-

‘পেট-পালা পাঞ্জু ফেরে স্কন্ধে ঝুলি লয়ে।’

 

অন্নচিন্তার লোকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়, জীবন-সংগ্রামে ভূলে যায় ধর্মকর্ম। অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান থেকে এ সম্বন্ধে কবি স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন-

‘ও মন যখন ভবে এলে, বলেছিলে গুরুর চরণে সাধবো মনের সাধে,
জননী জঠরে জন্মে নিল মহামায়ায় ঘিরে,
ভূলে গেলাম পূর্ব-কথা পেটের জালায়।’

 

আভিজাত্যের গৌরব, সামাজিক দম্ভ ইত্যাদি অন্নচিন্তার কাছে তুচ্ছ। তখন মনে হয় -

‘জাতে অন্ন নাহি দিবে’।

 

কবি এখানে বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। এটাই আধুনিক সাহিত্যের বিশেষ লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে অতি আধুনিক যুগের কবি সুকান্তের একটি বাণী স্মরনীয়। সুকান্ত বলেন-

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

 

জীবণ সম্পর্কে সুকান্তের এই কঠিন মন্তব্য প্রকাশের বহু পূর্বেই পাঞ্জু তাঁর সাহিত্যে ঐ জাতীয় ভাষা রেখে গেছেন।

মানব-প্রকৃতির সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ আধুনিক সাহিত্যের আর একটি বিশেষত্ব। সুখ-দুঃখের মিলিত রুপই জীবন। শান্তি ও অশান্তি পর্যায়ক্রমে দেখা যায় জীবণ চলার পথে। উভয়কেই একইভাবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু মানুষ তা পারে না। সুখে উল্লাসিত ও দুঃখে ম্রিয়মান হওয়া জীব-জগতের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কবি গেয়েছেন-

‘সুখে মন হয় রে তোলা,
দুখে মন হয় উতলা,
এই হলো ভবের খেলা।’

 

জীবণকে জানার এরুপ স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী পাঞ্জু শাহের ছিল। ‘জীবনের প্রতি রস-দৃষ্টিও সাহিত্যে আধুনিকতা সৃষ্টির একটি প্রধান লক্ষণ। পাঞ্জু সাহিত্যে এ লক্ষণ বর্তমান।

মধ্যযুগের সাহিত্য ধর্মীয় বিষয় ও দেব-দেবীর মাহাত্ন্য বর্ণনায় ভারাক্রান্ত, দেশ ও দেশের মানুষ সেখানে গৌণ। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে দেশাত্নবোধ এবং জন্মভূমি প্রীতি বিশেষভাবে প্রতিফলিত। পাঞ্জু শাহের মধ্যে দেশের প্রতি, গ্রামীণ জীবনের প্রতি একটি অকৃত্রিম দরদ ছিল। দেশের দূর্দিনে বৈদেশিক সাহায্য এনে কবি দেশকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন-

‘দেশের কৃষি মারা গেলে
খাওয়াবো উত্তরে ধান।’

 

এখানে দেশ সমস্যা, অন্নচিন্তা এবং মানব-কল্যাণ কামনা কবিকে দৃঢ় বাস্তবতার মধ্যে টেনে নিয়ে চিরন্তন জীবন-যন্ত্রনার অভিব্যক্তি ঘটাতে উৎসাহিত করেছে। এ যুগের সর্বহারা মানুষকে জানার সুযোগ তাঁর হয়েছিল বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে জনৈক সমালোচকের মন্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেন- ‘সবার উপর মানুষ সত্য’-ইহাই আধুনিক সহিত্যের মর্মবাণী এবং মানুষ বলিতে আধুনিকতা গোটা মানুষটিকেই বুঝে, মানুষের কিছুই বাদ দিতে চাহে না।

মানুষের যে স্থূল প্রবৃত্তি ও কামনা মানব জীবনের প্রধান উপাদান, তাহাই আধুনিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিপাদ্য হইয়াছে। পাঞ্জু সাহিত্যে এই ‘মানুষ সত্য’ অর্থ্যাৎ‘আধ্যাত্ন-মানুষ-মাহাত্ন্য’ স্বীকার করেও রিপু ইন্দ্রিয় তাড়িত রক্ত-মাংসের ‘মানুষ’ স্বীকৃতি পেয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিত্য সনাতন মানুষ বর্তমান-একথা কবি বহুবার বলেছেন। ‘এই মানুষে সেই মানুষ আছে’- এই বলে তিনি সবার উপরে মানুষের স্থান নির্দেশ করেছেন। এমনকি ‘মানব সেবা শ্রেষ্ঠ উপাসনা - একথাও তাঁর রচনায় আছে। তিনি বলেছেন-‘মানুষ ছাড়া ভোজন সাধন করবি আর কোথায়।’ এসব মন্তব্য লক্ষ্য করলে মনে হয়, পাঞ্জু সাহিত্যে আধুনিকতার অভাব নেই।

নারীর জীবণ, নারীর-ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং সমাজ-জীবণে নারী-ঘটিত সমস্যা আধুনিক সাহিত্যের বহুল আলোচিত বিষয়। বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্র-সাহিত্যে এসম্পর্কে নব নব ব্যাখ্যা স্থান লাভ করেছে। পাঞ্জুু-সাহিত্যেও নারী-জীবণ উপেক্ষিত নয়। কবি রচিত ‘হাবিল কাবিলের বিবাদ’ শীর্ষক কবিতা পাঠ করলে একথার সত্যতা জানা যায়। একটি দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনীর সূচনা, বিকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। স্বাভাবিক একটি নাটকীয় আবহ কাহিনীকে আরো মর্মস্পর্শী করে তুলেছে। চরিত্র-সৃষ্টিতেও শাস্ত্রীয় বিষয়ের সাথে কবির রসদৃষ্টি যুক্ত হয়ে অপূর্ব ভাবসম্পদ উৎপন্ন করেছে। নারীর প্রতি লোভাতুর মনোভাব কত মারাত্নক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কবিতার মধ্যে তার চমৎকার বর্ণনা আছে। হাবিল কর্তৃক কাবিলের জীবণনাশ, পৃথক পৃথক জাতির উৎপত্তি প্রভূতি ঘটনার অবতারণা থেকে আধুনিক জীবণের মর্মমূলে পৌছানোর জন্য কবির ঐকান্তিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং নারীত্ব রক্ষার প্রতিও কবি যথেষ্ট যত্নশীল।

ব্যক্তিগত জীবণের প্রতিচ্ছায়া কখনো কখনো সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। পাঞ্জু-সাহিত্যে এ ব্যাপারটি ঘটছে। দুজন স্ত্রী নিয়ে কবি সংসার করতেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করেও হয়তো তাঁদের মনোতুষ্টি করা যেত না। কবি তাই বলেছেন-

‘তোর এত মত যত্ন করি,
তবু তেড়া নয়ন গেল না।’

 

এখানে পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ ও আনন্দ বেদনা বাস্তব রুপ লাভ করেছে। রুপকে, প্রতীকে ও উপমায় ফুটে উঠেছে কবির অন্তরাত্নার ছবি। তত্ত্বকথায় কবিকে এখানে ব্যবহারিক জীবণের চত্ত্বরে নামতে দেখা যায়। এখানে তিনি সংগ্রাম মূখর, পলায়নপর নন। আধুনিক সংসারী জীবণের দায়িত্বপূর্ণ অংশটি তিনি গ্রহণ করেছেন। আর তাই পাঞ্জুু সাহিত্যে তত্ত্বের মাঝেও একজন যুদ্ধরত নায়ককে আমরা খুঁজে পাই। কবি নিজেই সেই নায়ক, যাঁর সমস্ত সৃষ্টি তাঁর জীবণ থেকে নেয়া, এখানেই তিনি অনেকখানি আধুনিক।

কুরআন ও বাইবেলে মনুষ্য সৃষ্টির কথা বর্ণিত হয়েছে। পাজ্ঞু শাহ ঐখান থেকে তথ্য নিয়ে ‘পূর্ব কথার বয়ান’ শীর্ষক একটি কবিতা রচনা করেছেন। শাস্ত্রের বিষয় হলেও সংগ্রামময় মানব জীবণের কথা রমনীয় ভাষায় বর্ণনা করাই কবির লক্ষ্য। শয়তানের সাথে দ্বন্দ্ব করে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করবে এটাই কবির বাসনা। মাইকেল মধুসূদন যেমন রামায়নের কাহিনী অবলম্বন করে ‘মেঘনাথবধ’ কাব্যে আধুনিক কাব্যকলার বিকাশ ঘটিয়েছেন, পাশ্চাত্য আদর্শে মহাকাব্য রচনা করেছেন, কবি পাজ্ঞু শাহও তেমনি জীবণকে রুপায়িত করেছেন আদম-হাওয়ার কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে। শয়তানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় মানুষ জয়ী হবে, মানবিক শক্তি অপরাজেয় বলে গন্য হবে - এ যেন স্রষ্টারও ইচ্ছা। শয়তানকে আল্লাহ বলেন-

‘তোমার ভোলেতে সেহ কভূ না ভূলিবে।’

 

বস্তুত শয়তানের সাথে প্রতিযোগীতায় মানুষের বিজয় ঘোষণা, গন্ধম খাওয়ার ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে আদম-হাওয়াকে মাটির পৃথিবীতে মানব-মানবীরুপে চিত্রিত করার প্রবণতা আধুনিক মানসিকতারই লক্ষণ। পাঞ্জু সাহিত্যে সেই লক্ষণ আছে।

প্রকৃতি বর্ণনা আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাঞ্জু সাহিত্যে ব্যাপক না হলেও স্থান বিশেষে মনোরম প্রকৃতি বর্ণনা পাওয়া যায়। কাঠুরিয়ার স্ত্রী মোড়লের যৌন-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সুযোগ দিতে রওনা হবে, এমন সময় প্রবল ঝটিকা ও বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এখানে প্রাকৃতিক দূর্যোগের একটি গুরুগম্ভীর বর্ণনা থেকে কবির নিসর্গপ্রীতি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন-

‘বারো মেঘ আল্লাতালা আপে সাজাইয়া।
ঝড়ি আর পানি আল্লা দিল বরসিয়া।

 

পাঞ্জু শাহের পূর্ববর্তী অনেক কবির কাব্যে কবি-পরিচিতির অভাব। কাব্য-রচনায় কাল নির্ণয়ই বড়ই দুরুহ ব্যাপার। সমকালীন বহু গ্রন্থেও বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত। কিন্তু পাঞ্জু শাহের কাব্যে কবির পরিচয় ও রচনাকাল অতি ষ্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। মনে হয়, কবি খুব সহজভাবে পাঠক-হৃদয়ে আতœপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে চান। ‘পাঠান কূলেতে জন্ম জানিবা আমার’- বলে কবি যেভাবে আত্নবিবরণ পেশ করতে শুরু করেছেন, তা থেকে তাঁকে আধুনিক বাস্তবের কবি বলেই ধারণা করা হয়।

আত্নপ্রত্যয়শীল অভিব্যক্তি আধুনিক কবি-ভাবনার বিশেষত্ব। অন্য দিকে দেখা যায়, মরমীয়া ভাবসাধক সর্বদা আতœপ্রচারে বিমুখ। এমনকি আধুনিক কিছু কবিও নৈরাশ্যবাদ পোষণ করেন। কিন্তু পাঞ্জু শাহ ছিলেন আত্নপ্রত্যয়শীল আশাবাদী কবি। তাঁর কাব্য থেকে একটু উদ্ধৃতি দিলেই বিষয়টির সত্যতা জানা যাবে। কবি বলেন-

‘বহুত যে গান আমি রচনা করিয়া।
মুল্লুকে মুল্লুকে লোকে দিছি শিখাইয়া।’

 

সঙ্গীত রচনা ও প্রচার সম্পর্কে কবির এ মন্তব্য থেকে তাঁকে আমরা একজন দৃঢ়চেতা আশাবাদী আধুনিক কবি রুপেই পাই। এ সময়ে পদ্য-ছন্দকে কাব্যের একমাত্র বাহন বলে মনে করা হতো। এখন গদ্যছন্দও কাব্যে বহুল পরিমাণে প্রচলিত হয়েছে। গদ্য-কবিতা বর্তমান সাহিত্যের বিশিষ্ট লক্ষণাত্বক রচনা। পাঞ্জু শাহ তাঁর কাব্যে গদ্যছন্দ ব্যবহার করেননি বটে, তবে কিছু গদ্য-রচনাকে তিনি তাঁর কাব্যের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। এই গদ্য-প্রীতি থেকে তাঁর আধুনিক মানস-পরিচয় পাওয়া যায়।

কবি-মানসে আধুনিকতার সবচেয়ে বড় লক্ষণ ‘সমকালীর জীবণ-চেতনা’। পাঞ্জু কাব্যে উনিশ শতকের শহর-কেন্দ্রিক জীবণের রুপময় চিত্র রমনীয়ভাবে চিত্রিত হয়নি সত্য, কিন্তু সমকালীন জীবন সম্পর্কে কবি একেবারে উদাসীন ছিলেন, একথা বলা যায় না। বন্যা, ঝড়, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় সমকালীন সমাজ-জীবনে যে সংকটের সৃষ্টি করেছিল, সন-তারিখ উল্লেখ করে কবি তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরেছেন। কবির রচনা থেকে দৃষ্টান্তসহ কিছু আলোচনা উপস্থাপন করা যায়।

১২৯৭ বঙ্গাব্দে সমগ্র বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা যায়। সর্বগ্রাসী বন্যায় হিং¯্র ছোবল থেকে কেউ রেহাই পায়নি। ধান-পাট ডুবে যায়, আম, জাম ও কাঁঠাল বাগান প্লাবিত হয়, গৃহস্থের উঠান দিয়ে বন্যার পানি প্রবল বেগে ছুটে চলে। গৃহবধুদের দূর্দশা চরমে ওঠে। উঠানে তৈরী বাঁশের মাচার ধান ও জালানি কাঠ শুকানো হতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের মানুষ ও পশু খাদ্যাভাবে মৃত্যুর মুখোমুখী এসে দাঁড়ায়। গৃহকর্তার মান সম্মান বিপন্ন হয়ে পড়ে। কবি এ দৃশ্য শুধু যে দেখেছেন তাই নয়, তাঁর নিজের জীবণ দিয়ে এ বেদনাদায়ক অবস্থা উপলদ্ধি করেছেন। কবির কন্ঠ থেকে তাই অস্ফুটে বেরিয়ে আসে-

‘জলের খেলা, দেখে ঠেলা, কম্প হল মহাপ্রাণ,
সাতানব্বই সালের বন্যায় থাকলো না আর কূল-মান।’

 

এলাকাবাসীর দুঃখ-কষ্ট কবির নিজস্ব দুঃখ-কষ্টের আকারে বর্ণিত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কবির বসতবাটির তিন পাশ দিয়ে তিনটি খালের পানি-প্রবাহ পরিবার-পরিজনসহ কবিকে সঙ্কিত করে তুলেছিল। কবির ভাষায়-

‘দোবিলে আর ফকরে খাল,
বরোই তলা ডাকে জল,
হোল কি তুফান,
তিন খালের ধাক্কায় পড়ে
পাঞ্জু ফকির খাবি খান।’

 

কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি এখানে সার্বজনীন অনুভূতিতে অভিব্যক্ত। একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগে মানব-জীবন যে কতখানি বিপর্যস্ত হতে পারে, পাঞ্জু শাহের এ বক্তব্য থেকে তা অনুধাবন করা যায়। এদেশের মানুষের জীবনে দূভিক্ষ একটি মারাত্নক ব্যাধি। কবিতায় দূর্ভিক্ষের চিত্র ফুটিয়ে তোলা কবিদেরই কাজ। পাঞ্জু শাহের কবিতায় ও গানে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের বর্ণনা আছে। সমকালীন নিরন্ন মানুষের জীবন-যন্ত্রণা কয়েক ছত্রেই কবি তুলে ধরেছেন-

‘কিরুপে ছেলেপেলে মানুষ করি।
তের শ’ সাল চারি, ধান-চাল আক্কারা ভারি,
হয়েছে দানার আকাল, পুড়েছে তুলার কপাল,
ঘরে বাইরে কি করিতে কি করি।।’

 

খাদ্য-সঙ্কটে মাতাপিতা চিন্তিত, সন্তান-সন্ততি বাঁচানোর ভাবনায় তাঁরা অস্থির। খাবার কেনার টাকা নাই, গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা নিতে চাইলেও ফাঁকিবাজ মহাজন তা দেয় না। টাকার মান কম, জিনিশের দাম বেশী, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা সীমিত। আপন আত্নীয় এমনকি আদুরে জামাই পর্যন্ত শ্বশুর-বাড়ী গিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদা পায়না। স্নেহের নাতিপুতিও দাদাদাদীর এবং নানানানীর আদর থেকে বঞ্চিত হয়। তাই দেখা যায়-

‘তাতে মনে বুড়োবুড়ি,
জামাই যায় শ্বশুর বাড়ি,
বেটার তো বুদ্ধি ভারি, মশি মশি।
দুখের সময় সুখের কথা,
খাটে না ও সব কথা,
কি করব নাতাপোতা,
পেটের জ্বালায় জ¦লে মরি।।

 

জঠর-যন্ত্রনা মানুষকে সব কিছু ভূলিয়ে দেন, এক মুষ্টি অন্ন হয়ে ওঠে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু। কবি পাঞ্জু শাহ পূর্বোক্ত দূর্ভিক্ষের সর্বনাশা রুপ বর্ণনা প্রসঙ্গে সমকালীন জীবন-চেতনা তুলে ধরেছেন। আগেও আমরা সুকান্তের জীবন চেতনার কথা উল্লেখ করেছি। এখানেও এ প্রসঙ্গই স্মরণীয়। পাঞ্জু শাহের এই জীবনোপলদ্ধি নিঃসন্দেহে আধুনিক লক্ষণাত্বক।

বন্য ও দূর্ভিক্ষের মতো ঘূর্ণিঝড় মানুষের জীবনকে কতখানি দুঃখময় করে তোলে, ১৩১৬ বঙ্গাব্দের প্রবাহিত আশ্বিনী ঝড়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি তা উল্লেখ করেছেন। ঐদিন ছিল গ্রাম বাংলার একটি লৌকিক উৎসব-গারশী এবং মুসলিম জাহনের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব- ঈদ-উল-ফিতর। কবির ভাষায় -

‘তের’শ ষোল সালে গারশীর রাত্রি উদয় হয়।
গারশীর দিনে আল্লার শিন্নী, মহৎ আর কাঙ্গালিনী
সবারই আনন্দময়।
বসে গিন্নি পাকায় শিন্নী,
কারবা শিন্নী কেবা খায়।।

 

আকস্মিক বিপদে দেশের মানুষেরা যে সব দুঃখ-দৈন্য ভোগ করেছে, কবি সেগুলোর যথার্থ করুণ মধুর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কবিতায় ও গানে।

এখানে আরো একটু ব্যবহারিক জীবনে ফিরে যেতে চাই, যেখানে পাঞ্জু-চিন্তায় আরো বাস্তবমুখী আধুনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা জানি, উনিশ শতকের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টির জন্য বহু প্রয়োজনীয় দ্রব্য উপহার দিয়েছে। শহরের লোকেরা ঐ সব আধুনিক জীবনোপকরণ ভোগ করে থাকে। এসব আবিস্কারের প্রভাব গ্রামীণ জীবনে খুব ব্যপক নয়। কিন্তু পাঞ্জু শাহের জীবনকালে গ্রামাঞ্চলেও যে ঐসব বৈজ্ঞানিক আবিস্কার পৌঁছে গেছে, তা তাঁর রচনায় উল্লেখিত হয়েছে। আগুন জালানোর আধুনিক যন্ত্র ‘দিয়াশলাই’ বা ‘সেফটি ম্যাচ’ দেখে কবি বিস্ময়ে বলে উঠেছেন-

‘কি মজার দিয়াশলাই পাই ইংরাজ হইতে।
দিচ্ছে ঝলক, করছে শলোক, অন্ধকার রাত্রিতে।’

 

ইংরেজ আবিস্কারের প্রশংসাসূচক উক্তি পাঞ্জু শাহকে পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণগ্রাহী ব্যক্তি বলে প্রমাণ করে।

কবি-হৃদয়ে সমকালীন জীবন-চেতনা স্পষ্ট ছায়া ফেলে। প্রকাশ ভঙ্গীর তারতম্য অনুসারে যে চেতনা-চিত্র পূর্ণ বা অপূর্ণ রুপ পায়। পাঞ্জু শাহ জীবন সায়াহ্নে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের খবর পেয়েছিলেন বলে তাঁর রচনাদৃষ্টে মনে হয়। এ খবরে তাঁর মরমী-মন বেদনায় ভরে ওঠে। জীবন-বিধ্বংসী সমরসজ্জা তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তাঁর ভাষায়-

‘কলকাতার বাবুরা সব,
বাড়ি এসে হল নীরব
মহাসমর বেধে গেছে, জানি না কি হয়।

 

শহরে বসবাসকারী শহরবাসীদের গ্রামে ফেরার দৃশ্য কবি-মনকে নাড়া দিয়েছে। সমকালীন বাবু শ্রেণীর বিলাসী নাগরিক জীবনেও তখন বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নেমে এসেছে, পাঞ্জু রচনায় তার নমুনা বর্তমান। ‘চৌদ্দ সালে বোমায় হলো জগতময়’- বলতে কবি ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথাই বলেছেন। স্মরণ করা যায় যে, ঐ বছরই কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। গানে বিধৃত মহাসময়ের খবর কবির মনের আধুনিক চিন্তা-ধারার বহিবিকাশই বুঝায়। তিনি বলেন-

‘কামান বন্দুক বোমাবাজী
মানুষকে পশু বানায় আজি,
সৎকাজে মন হয় না রাজী,
ভাইয়ের রক্ত ভাই পিয়েছে।।’

 

পরিশেষে দেখতে পাই, পাঞ্জু শাহের ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকে মধ্যযুগীয় প্রভাব রয়েছে। তা সত্ত্বেও সে সাহিত্য আধুনিক ভাবনা-বর্জিত নয়। বস্তুত বাহ্যজগত ও অন্তর্জগত পাঞ্জু শাহের প্রগতিশীল ভাবনায় আধুনিক চেতনায় মধুময় হয়ে উঠেছে। ত্যাগী সাধক হয়েও তিনি জীবনের সর্বোতমুখী আবেদনকে অস্বীকার করেননি। যদি জীবনের সবগুলো দিককে স্বীকার করে নেওয়ার নামই আধুনিকতা হয়, তাহলে পাঞ্জু সাহিত্যে সে আধুনিকতার বিকাশ আছে। বস্তুত পুথি সাহিত্যের কবি, ভাব সঙ্গীতের রচয়িতা, সম্বন্বয়বাদী সাধকদের উত্তরসুরী এবং সুফী তত্ত্বের ধারক বাহক এই কবি আধুনিক শহর থেকে দূরে আবহমান বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লীর বুকে বসেও যে সাহিত্য রচনা করেছেন, তাঁর জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারেই সে সাহিত্যে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই বলা যায়, কাব্যে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা, জীবন যন্ত্রনার করুন চিত্র, মানব প্রকৃতির বিচার, মানুষের মূল্যবোধ, নারী-প্রাধান্য, ব্যক্তিজীবনের প্রতিচ্ছায়া, মানব-সৃষ্টি বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি বর্ণনা, সমকালীন জীবন-চেতনা ইত্যাদি উপস্থাপন পাঞ্জু শাহকে যথেষ্ট আধুনিক ও প্রগতিশীল করে তুলেছে। যদিও তিনি পুঁথি ও সঙ্গীত রচয়িতা, তথাপি তাঁর কাব্যে আধুনিক চিন্তার অভাব ছিল না। এখানেই তাঁর কবি-কর্মের সাফল্য।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।