বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

ফকির লালন সাঁই এর দর্শন এবং তারুণ্যের দায়বদ্ধতা - পলাশ বসু
ফকির লালন সাঁই এর দর্শন এবং তারুণ্যের দায়বদ্ধতা - পলাশ বসু

ফকির লালন সাঁই তাঁর জীবদ্দশায় প্রতি বছর দোল পূর্নিমার রাতে ভক্ত-সাধুদের নিয়ে এক মিলন উৎসবের আয়োজন করতেন। সারারাত ধরে চলত এ সাধুসঙ্গ। সেটিকে উপজীব্য করেই প্রতি বছর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় পালিত হয় তিন/পাঁচদিনব্যাপী লালন স্মরণ উৎসব। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই একথা যেমন সত্য তেমনিভাবে তিরোধানের পরেও যে তাঁর চিন্তা ও দর্শন আমাদের ভাবনার জগতে ঢেউ তোলে– এটিও চরম সত্য; সে ঢেউ প্রবাহমান হবে যুগ যুগ ধরে সেটি আরও সত্য। আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে সেই দর্শন তাই নানাভাবে ঘুরে ফিরে আসছে, আসবে বারংবার। কারন, হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভেদমুক্ত সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী বিনির্মানে আমরা যারা তরুণ তাদের জন্য লালন দর্শন এক অনন্য আলোকবর্তিকারূপে পরিগণিত হতে বাধ্য।

লালন ফকিরের সর্ব পরিচয় তাঁর গানে। আমরা লালন ফকির কে আমাদের মনের মনিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছি তাঁর সৃষ্ট অসাধারন সব মরমী সংগীতের জন্য। কারন, তাঁর রচিত ও সুরারোপিত এ সকল অসাধারন দার্শনিক ভাবপূর্ন গান আমাদের চিন্তাজগতে উথাল পাথাল ঢেউ তোলে। স্বত:স্ফুর্তভাবে তাঁর মনের গহীনে জন্ম নেওয়া এ সংগীতগুলো তাই আজ এক একটি দর্শন।কি নেই তাতে? আছে দেহতত্ব, আত্মতত্ব, গুরুতত্ব, ভক্তিতত্ব। আছে নবীজি, কৃষ্ণ, যীশু, বেদ, কোরান, স্রষ্ঠা প্রভৃতি বিষয়ক তাঁর সুচিন্তিত মত, জিজ্ঞাসা এবং উত্তর।

আমরা লালন সাঁইজির গানের প্রথম সংগ্রাহক হিসেবে কবিগুরুর নাম জানতে পারি। প্রায় শ’খানেক এর উপরে এই মরমী সাধকের গানের সংগ্রাহক কবিগুরু নিজেই।প্রবাসী পত্রিকার ‘হারামনি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করেন।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কবিগুরু কেন সাঁইজির গান সংগ্রহ ও প্রকাশে তাঁর অমূল্য সময় ব্যয় করেছিলেন? এমনভাবে কেন তিনি লালন দর্শন প্রচারে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন?নিজে প্রখ্যাত গীতিকার,সুরকার ও গায়ক হয়েও কবিগুরু কেন লালন সংগীতে মন সমর্পন করেছিলেন? কি এমন লুকায়িত জীবন দর্শনের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিল? কিসের এমন দুর্নিবার আকর্ষনে তিনি বাউল জীবনের গভীরে প্রবেশে ব্রতী হয়েছিলেন?শুধু নিজে এ রস আস্বাদনের চেষ্টা করেছেন এমন নয়। বিভাজিত ধরণীর বালুমহলে সে রস ছড়িয়ে দিয়ে উত্তাপ কমাতে তৎপর হয়েছেন।যাই হোক, জীবনের জন্যে যদি জীবন হয়, মানবের তরে যদি মানবের ঠিকানা হয় তাহলে লালন দর্শনে রবি ঠাকুরের অবগাহন অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময়, আকর্ষনীয় ও চিত্তাকর্ষক তা বলাই বাহুল্য। তাই, সে আঙ্গিকে উপরের প্রশ্নসমুহের উত্তর হয়ত আমরা কিছুটা নিম্নোক্ত আলোচনা থেকে পেতে পারি।

সাঁইজির গান শুনে কবিগুরু রীতিমতো বিমোহিত হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।ভাবসাগরে ডুব দিয়ে তাই বিলক্ষন জেনেছেন ও বুঝেছেন লালন দর্শন ফুরাবার নয়।নিরন্তর প্রবাহমান সে উৎস।উৎসমুলে যা প্রগাঢ় শক্তিমত্তা নিয়ে প্রস্ফুটিত তাই গানে গানে বিকশিত হয়েছে শতদলে। আর এ কারনেই হয়ত,লালনের গান প্রথম কবিগুরুই বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন।‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানটি কবিগুরু ইংরেজীতে ভাষান্তর করে বিশ্ববাসীর সামনে এ মহান সাধক ও দার্শনিক কে তুলে ধরেন।যার ফলে দেশীয় পরিমন্ডল ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বেও এ মানবতাবাদী গায়ক,সাধক ও দার্শনিকের চিন্তা-চেতনা ও জীবনদর্শন অবগুন্ঠনের খোলস ছেড়ে প্রস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে।এভাবে, ধীরে ধীরে সাঁইজি সমগ্র বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে থাকনে।আজ তো বিশ্বব্যাপী লালন দর্শন নিয়ে রীতিমত গবেষনা শুরু হয়েছে।

অখন্ড অবসরে কবিগুরু অনেক সময় কাটিয়েছেন বাউলদের সাথে।দেখেছেন তাদের অতি সাধারন জীবন। কিন্তু তার চেয়েও অবাক বিস্ময়ে শুনেছেন, চমকিত হয়েছেন এ সকল বাউল ফকিরদের সাধারন শব্দচয়ন এর মাঝে লুকায়িত গভীর জীবন দর্শনে।বিস্ময়াবিভূত কবিগুরু তাই বলছেন-‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন – আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ’। যার সোজাসাপ্টা অর্থ হচ্ছে, কবিগুরু ফকির লালন সাঁইয়ের দর্শনের গুরুত্ব অন্তরের গভীরতম স্থানে অনুভব করতে পেরেছিলেন। অনুভবের সে ডালির প্রকাশ তাই হয়তো উপর্যুক্ত মন্তব্যের মাধ্যমে-ই তিনি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন এবং অন্য সকল পন্ডিত ও জ্ঞাণীগুনীজনের মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করেছেন।

লালনের জাত বিষয়ক শানিত চিন্তার কথা আজ সকলের জানা।জাত-পাত, উঁচু-নিচু, ইতর-ভদ্র, হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ইত্যাদি ভেদাভেদ তাঁকে অবাক করেছে।আহত করেছে।তাই এ সমস্ত ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে তিনি একীভূত মানব সমাজের কল্পনা করেছেন। জাত-পাত কে তিনি একদমই থোড়াই কেয়ার করেছেন।তাই তো তিনি বলছেন- ‘জাত গেল জাত গেল বলে / একি আজব কারখানা/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি / সবই দেখি তানা নানা’। অন্য আর একটি গানে বলছেন- ‘কেউ মালা কেউ তজবী গলায় / তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায় / যাওয়া কিংবা আসার বেলায় / জাতের চিহ্ন রয় কার রে’?

মানুষকে বিভক্তির বেড়াজালে না জড়িয়ে শুধু মানুষ হিসেবে দেখার কারনেই হয়তো তিনি মানুষ কে গুরুভাবে ভজতে বলেছেন। কারন, তাতেই লুকায়িত আছে শাশ্বত প্রেমের অমিয়ধারা- মানবমুক্তি যার ফল। কলিযুগে তিনি মানুষকে দেখেছেন অবতার হিসেবে। বলেছেন দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তা জানতে পারে না্। মানুষ ভজনা ও মানব সেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে জ্ঞান।কারন,নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেয় সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে-‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার / মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার / নদী কিংবা বিল বাওড় খাল / সর্বস্থলে একই একজন…. / দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায় / কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার’।

লালন ফকিরের গানের একটি আলাদা তাৎপর্য হচ্ছে সাধারনত এ গান গুলোর শেষদিকে এসে লালন তাঁর নিজের নামে পদ রচনা করেছেন।এর ফলে যেটা হয়েছে তা হলো, তাঁর গান আর অন্য কেউ নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারবেন না।যেমন, বহুল পরিচিত জাত বিষয়ক গানে লালন শেষ দিকে বলছেন- ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় / তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয় / লালন বলে জাত কারে কয় / এ ভ্রম তো গেল না’।

কত সহজ ভাষায় দার্শনিক প্রশ্ন করা যায়- তা লালন কে না জানলে বোঝা কঠিন।তাঁর প্রতিটি গান আমাদেরকে অনেক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।উত্তর আমাদের জানা থাকলেও কি যেন এক অজানা আতংকে সত্যের মুখোমুখি দাড়িয়েও আমরা আমাদের অবস্থান নিই বিবেকের বিরুদ্ধে।লালন তাঁর বিবেক কে সদা জাগ্রত রাখতে পেরেছিলেন বলেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বিচলিত হননি।প্রচলিত সকল ধর্মমত কে জেনে-বুঝেই অত:পর তিনি তাঁর সত্য উপলব্ধিকে নি:সংকোচে প্রকাশ করেছেন ‘লালনীয়’ ভঙ্গিতে । তাঁর সে উপলব্ধির-ই বহি:প্রকাশ ঘটেছে মরমী সব গানে যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ, ভন্ডামি, ধর্মীয় গোড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন শুধুই মানবতা আর সংশয়হীন চিত্তে গেয়েছেন তার-ই জয়গান।

তাঁর এ গান যেন এক অসীম শক্তির আঁধার যার কেন্দ্রে আছে শুধুই মানুষ। মানবতাবোধ যার একমাত্র উপজীব্য। কিন্তু মানবতাবোধে কতজন আমরা নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি? নাকি নানান ফন্দি ফিকিরে আমরা মানবতাবোধকে দলিত মথিত করে চলেছি প্রতিনিয়ত? সমাজ পরিমন্ডলে কি আমরা এমন কোন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি যেখানে মানবতাবোধকে লালন পালন করা হয়ে থাকে? উত্তর হচ্ছে না। আর পারিনি বলেই হয়তো সাঁইজির ভাষায় তা ‘কানার হাট-বাজার’। তাই, কানার এ হাট-বাজারে লালনের পরামর্শ ভাবনার জগতে ঢেউ তোলে। লালন তাই বলছেন ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে / পাবিরে অমুল্য নিধি বর্তমানে’। তবে ধীরে হলেও লালন এখন অভিজাতকুলেরও আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।বাউলদের শ্রেষ্ঠধন লালনকে এখন বিদেশ বিভুয়ের মানুষজনও জানতে চায়।লালন দর্শনের রস আস্বাদন করতে চায়।

বর্তমান সময়ে লালন দর্শন তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয় প্রতিটি মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়ে যারা এক ও অভিন্ন মানবসত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। ভেদাভেদ নয়;অভেদ দর্শনই যে পারে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মান করতে সেটাই লালন ফকিরের গানে ফুটে উঠেছে। তাই লালন দর্শনের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে আমরা তরুন প্রজন্ম যেন তেমন পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই-সে প্রত্যাশা রইলো।

তথ্য সংগ্রহঃ- পলাশ বসু - ব্লগ বিডি নিউজ২৪ ডট কম

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

লালন স্মরণোৎসব  ২০২৪
লালন স্মরণোৎসব ২০২৪

লালন স্মরণোৎসব ২০২৪

  • Sub Title: একদিনের দোল পূর্ণিমার লালন স্মরণোৎসব ২০২৪

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।