নয়নে না দেখিলাম যারে
কি মতে ভজিব তারে।
নিচের বালু না গুনিয়ে
আকাশ ধরছ অন্ধকারে।।
আঁধার ঘরে সর্প ধরা
সাপ নাই প্রত্যয় করা।
লালন তেমনি বুদ্ধিহারা
পাগলের প্রায়।।
লালন দর্শনে আল্লাহকে পেতে হয় নবিকে চিনে, নবি ভিন্ন খোদার ভেদ অসম্ভব। কিন্তু নবি কারে বলি সেই মর্মার্থ সৃষ্টির মূল থেকে জানা দরকার। তাই দৃশ্যমান আকারে, বর্তমানে, আহাদে লালন দেখতে চায় সেই মৃত্যুহীন চিরঞ্জীব নবিকে, চারযুগে বিরাজমান এক জগত ত্রাতাকে। এবং লক্ষণীয় এই সত্য লালনের কুরআন থেকে পাওয়া।
হায়াতুল মুরসালিন বলে
কুরআনেতে লিখা দেখি।
সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
রাসুল চিনলে আখের পাবি।।
যে নবি পারের কাণ্ডার
জিন্দা সে চার যুগের পর।
হায়াতুল মুরসালিন নাম তাঁর
সেই জন্য কয়।
বর্তমানে কোন রূপে পাওয়া যাবে নবিকে সেই অনুসন্ধানই লালনমতে সাধকের কার্য। অদৃশ্য নিরাকার নয়, অন্য যুগের কোন অবতার নয়, কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নয়- লালন কেবল বর্তমানের মানুষকে ভজেই এই নুর-সাধনা সিদ্ধ করতে চায়।
আইন সত্য মানুষ বর্ত্ম
করো এই বেলা।।
ক্রমে ক্রমে হৃৎকমলে
খেলবে নুরের খেলা।।
লালন ফকিরের দর্শন মূলত এক গুরুমুখী করণ-সাধনা। এই পথে গুরুই পতিত পাবন, পরম ঈশ্বর, দয়াল চাঁদ- যদিও রক্তমাংসের মানুষ ভিন্ন অন্য কিছু সে নয় । এই জ্যান্ত গুরু-রূপ বর্জখ করেই সাধক স্বরূপ খোঁজে। শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু, সাধনগুরু, চেতনগুরু এই চার প্রকার চরনে সিদ্ধ হয় সাধন। ভক্তিই এই সাধনার বল কেননা গুরু ভক্তির অধীন। গুরুর পরশে লোহা সোনা হয়, অন্ধ দেখে কালায় শোনে, ল্যাংরা সেও নাচে- এমনি তাঁর মহিমা। সাধনতত্ত্বের কোন শাস্ত্র নাই। গভীর নিগুম আপ্ততত্ত্ব জানতে হয় সম্যক গুরুর নির্দেশ মেনে জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির বিকাশ ঘটিয়ে, কেননা এটি একটি জীবন সাধনা। ক্রমে ক্রমে হৃৎকমল উজালা করে আমার আমিকে জানা। আর নিজেকে জানতে পারলেই সকল জানা যায়।
গুরু পদে নিষ্ঠা মন যার হবে।।
যাবে তার সব অসুসার
অমূল্য ধন হাতে সেহি পাবে।।
যথা-আলেক মোকাম বাড়ি
সফিউল্লা তাহার সিঁড়ি।
লালন বলে মন-বেড়ি
লাগা গুরুর পা’য়।।
লালন দর্শনে দেহ এক মহা বিষয়। যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই দেহ ভাণ্ডে। দেহের ভেতরেই সাঁই নিরঞ্জনের খেলা, নবির নুরের জ্যোতি, আরস বারি। দেহ ভিন্ন লালন সাধকের তাই আর কোন তীর্থ নাই। তবে এও সত্য যে লালনের এই সাধনা শেষমেশ এক মিথুনাত্মক যুগল সাধনাতেই পরিসমাপ্তি যাচে। দেহ-যুগলের মিলনেই শুধু সাঁই-দর্শন সম্ভব, আর কিছুতে নয়, এটাই বীজমন্ত্র। যুগলে ভজে অধরাকে ধরার এই গুপ্ত চর্চায় দেহই মন্দির, আর মিলন উপাসনা। এখানে আরেকটি বিষয় জানা জরুরি যে এই সাধনায় সাধক নয় বরং সাধন-সঙ্গিনীই মূল কাণ্ডারি, যার প্রসাদ ছাড়া পার অসম্ভব। সেই হয় চেতনগুরু, অন্য নামে শ্রীগুরু। যুগল-সাধনায় মিলনের চরম মুহুর্তে পুরুষ(সাঁই) হয় প্রকৃতি আর প্রকৃতি( দেহ, নবি) হয় পুরুষ। কিন্তু দেহতত্ত্বের এই অজান খবর জানা সামান্যের কাজ নয়, কারন এই দেহ এই পঞ্চভুতের জগত এক অবিচ্ছেদ্য হেতুকরনে অহর্নিশী দ্বন্দ্বমুখর, প্রপঞ্চনাই যার স্বভাব। দেহকাম থামে না, তৃপ্ত হয়না। সমস্ত সাগর চুষে নিতে চায় যে পাখি তার আহার জোগানো সত্যি এক অসম্ভব করণী। ক্ষুধার্ত জংলা পাখিটাকে তাই প্রথমে পোষ মানায়ে তারপর করতে হয় প্রেম- চতুর সাধক সে পথেই যায়।
প্রেমই লালন দর্শনের প্রাণ। প্রেমের শুদ্ধতায় নিষ্ঠা না এলে এই দর্শন শুধুই অসার শুষ্ক কথা। লালন মতে প্রেমেতেই সাধকের সিদ্ধি, প্রেমেতেই কারামুক্তি। সকল সাধনভজন, বাঁধনছাদন, ফকিরফিকিরি অবশেষে মিথ্যা হয়ে যায় যদি চিত্তে প্রেম না থাকে। প্রেমরতিতেই আচ্ছন্ন সেই অমূল্য নিধি, অধরা মাধুরীকে ধরার উপায়। লালনের বিভিন্ন পদে সেই আকুতিই বারবার ফিরে আসে।
শুদ্ধ প্রেম রাগে ডুবেথাকরে আমার মন।।
স্রোতে গা ডেলান দিওনারাগে বেয়ে যাও উজোন।।
নিভায়ে মদন জ্বালাঅহিমুণ্ডে করগে খেলা।
উভয় নিহার উর্ধব তালাপ্রেমেরি লক্ষণ।।
মুলাধারের মূল সেহি নূর
নুরের ভেদ অকুল সমুদ্দুর।
যার হয়েছে প্রেমের অঙ্কুর
ঝলক দিচ্ছে তারি।।
বাণে বাণ ক্ষেপনা বিষের উপার্জনা
অধঃপাতে গতি উভয় শেষখানা।
পঞ্চবাণের ছিলে প্রেমাস্ত্রে কাটিলে
হবে মানুষের করণ সারা।।
এক শুদ্ধ প্রেমকর্মই লালন দর্শন-সার, তারপরও কামহীন কোন অদ্ভুত প্রেমের কথা লালন বলেনা। কামছাড়া প্রেম তার মতে যথাতথা। কিন্তু সাধক কামে নাচে না, কামকে নাচায়। কাম তার কাছে তরঙ্গ–বিক্ষুব্ধ এক নদী (পথ), প্রেম লক্ষ্য (পার), আর এই দেহ সেই পারের তরী, গুরু কাণ্ডারি। কিন্তু পারের দেখা পাওয়া বা সিদ্ধিলাভ, যার জন্য জানতে হয় হেতুশূন্য করণ বা নিহেতু প্রেমসাধনা, সেই ভাব সামান্য জ্ঞানের কাজ নয়। রসিক শিখরে বাস করে যে সাধক সেই শুধু তারে পায়, বাকিরা ডুবে মরে তুফানে।
নিহেতু ভাব কি আদৌ সম্ভব? যুক্তিটি বোঝার জন্য দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্টের ‘শুদ্ধপ্রজ্ঞা’ সম্পর্কীয় বিখ্যাত ধারনাটি তবে জানা যাক। যে জ্ঞানশক্তি মানুষের লৌকিক ও ইন্দ্রিয়জ প্রেষণা বা কার্যকারণ সূত্রের আবশ্যিকতা ছাড়া আপন স্বাতন্ত্রের মুক্ততায় প্রকাশ পেতে পারে, তাই কান্টের বিচারে ‘শুদ্ধ প্রজ্ঞা’- মানব মনের একমাত্র পারমার্থিক অস্তিত্ব। প্রত্যাশাবিহীন নৈতিকতা আর নিষ্কাম রস-ভাবনা (নান্দনিক অনুভূতি ও প্রেম) তারই প্রমান দিচ্ছে বারবার জীবনের কিছু বিশেষ মুহুর্তগুলিতে। মনের এই বিস্ময়কর দুই স্বভাব থেকে মানুষের শুদ্ধ-প্রজ্ঞায় ঈশ্বর বা পরম-সত্তার অস্তিত্ব বস্তুবাদি কান্ট একসময় তাই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন, যদিও তার ভাষায় এই ঈশ্বর অধরা, অপ্রমাণ। কান্ট বিশ্বাস করে যে মানুষ আসলে দুই জগতের বাসিন্দা। সংবেদনশীল দেহান্দ্রিয় নিয়ে কার্যকারণে আবদ্ধ এক অবভাসিক জগতে যেমন তার অবাধ বাস তেমনি শুদ্ধ প্রজ্ঞার প্রেরণায় এক পরমার্থিক জগতেও হতে পারে বিচরণশীল, যেখানে স্বাতন্ত্র্যই নিয়ম। একই আত্মার যেন দুই রূপ। জাগতিক মোহ আর মূঢ় বন্ধন অতিক্রম করে অন্তরের পারমার্থিক স্বাতন্ত্র্যকে উদ্ভাসিত করাই তাই মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, কান্টের মতে যা আত্মসাধনা। কোন বাহ্য পদার্থে, ঐতিহাসিক ব্যক্তিতে বা মহাগ্রন্থে ঈশ্বরের অভিপ্রায়কে দেখতে পাওয়া কান্টের মতে স্রেফ পৌত্তলিকতা। বরং ধর্মবানী বা নির্দেশ মানুষের অন্তরাত্মা থেকেই কেবল উঠে আসতে পারে, শুদ্ধ প্রজ্ঞার জাগরনের মধ্য দিয়ে মনোজগৎ আলোকিত করে। ধর্ম বলতে বস্তুবাদী কান্ট শুধু এইটুকুই বোঝে।
লালন ফকিরের দর্শনেও আমরা অনেকটা একই অভিমত পাই। ‘সর্বভূতে ঈশ্বর’- ব্রহ্মধর্মের এই উপনিষদীয় বানী হয়ত লালন অস্বীকার করে না, কিন্তু সর্বভূতে নয় ফকির লালন ঈশ্বরকে খোঁজে শুধু মানুষে, মানুষের অন্তঃস্থলের হৃদ-কমলে, মনোদেহে, আকারে ও বর্তমানে। লালনের কাছে মানুষেই মূল সাধনা।
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।।
ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার।।
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার রূপ ধরে সে।
দিব্যজ্ঞানী হয় সেই জানতে পায়
কলির যুগে মানুষ অবতার।।
আছে আদমক্কা এই মানব দেহে
দেখনা রে মন ভেয়ে।।
দেশদেশান্তর দৌড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে।।
আগেই বলেছি, লালন দর্শনে মানব-দেহ একটি আধ্যাত্মিক বিষয়- নুরের আধার, পবিত্র পেয়ালা। কান্টের দর্শন থেকে এ পর্যায়েই লালনের ভিন্নতা স্পষ্ট। কান্টের ‘শুদ্ধ-প্রজ্ঞা’ কোন বস্তু নয়, জ্ঞানশক্তি আর লালনে তা বস্তু-শক্তিও বটে, সাধনযোগে যারে জানতে হয়। বৈরাগ্য বৃথা, বনে মুক্তি নাই- আপন দেহেই লালন খোঁজে তীর্থ, সাধনার বল, কান্টের মতো মানুষ যে দুই জগতে বাসিন্দা এ বিশ্বাসে ভর করে।
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।।
বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথা পড়শি বসত করে।।
সাধ্য কিরে আমারসে রূপ চিনিতে।।
অহর্নিশী মায়ার ঠুসিজ্ঞান চক্ষুতে।।
আমি আর অচিন একজন
এক জায়গাতে থাকি দুইজন।
মাঝে ফেরে লক্ষ যোজন
না পাই ধরিতে।।