কুষ্টিয়ার রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন
কুষ্টিয়ার রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন

পটভূমি: ১৯৪৭ সালের ১৪ইআগষ্ট পাকিস্তান ১৫ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর থেকেই দেশদুটিতে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বহুভাষিক ভারতে তখন কোন সর্বভারতীয় ভাষা ছিল না। এজন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কগণ এক ভাষার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবোধ গঠনের লক্ষ্যে ভারতের একটি আঞ্চলিক ভাষা হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের রাষ্ট্রভাষার এ ঘোষণাকে বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুরাও মেনে নিয়েছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল মূলত মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। ঐক্যের মৌলিক সূত্রকে পাশ কাটিয়ে ভাষার ঐক্যের বন্ধনে জাতি গঠনের জন্য পাকিস্তানি শাসকদের লক্ষ্য ছিল উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করা।

পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই অংশের অধিবাসীদের মধ্যে এক ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের মিল ছিল না। সংখ্যা গরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। একে রাষ্ট্র ভাষা করার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রথম থেকে সোচ্চার ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধী,বেলুচী,পাঞ্চাবী,পশতু ইত্যাদি ভাষার মিশ্রণ ছিল। উর্দূ ছিল ভারতের লক্ষৌ অঞ্চলের মুসলমানদের আঞ্চলিক ভাষা। ধর্মের আবরণে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলা ভাষাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল । এ লক্ষ্যে তারা উর্দূ হরফে বাংলা লেখার অদ্ভূত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু বাংলা ভাষাকে তা কোন ভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি। উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্তকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন সংঘটন করতে থাকে । এদের নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনে সর্বত্র গনজোয়ার সৃষ্টি হয় ।

তমদ্দুন মজলিস, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন তখন জনসাধারনের মাঝে ব্যাপক প্রেরণা সঞ্চার করেছিল । যার কারণে শত নিপীড়নের পরও বাঙালিরা রাষ্ট্র ভাষার দাবী থেকে সরে আসেনি । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে গতি ধারা বিস্তৃত হচ্ছিল তার তরঙ্গ এসেছিল কুষ্টিয়াতেও ।

কুষ্টিয়ার রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন: ১৯৫০ সালে জুলফিকার হায়দার (বর্তমানে কুষ্টিয়া হাই স্কুলের অবঃ শিক্ষক) রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন । কেন্দ্রের পরামর্শে ক্রমে তিনি নিজে আহবায়ক হয়ে নজমউদ্দিন আহমেদ, সামসুজ্জোহা, জালাল উদ্দিন খান প্রমূখদের নিয়ে তমদ্দুন মজলিসের জেলা শাখা গঠন করেন । ১৯৫১ সালে তমদ্দুন মজলিসের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয় । অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার সভাপতি এবং নজমউদ্দিন আহমেদ সেক্রেটারি নির্বাচিত হন । পরবর্তীতে মুহাঃ সিরাজ উদ্দিন, এ্যাডঃ চৌধুরী জালাল উদ্দিন আহমদ, খন্দকার তালেব আলী, ই.টি ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল হক এই সংগঠনে যোগদান করেন ।

তাদের নিয়মিত সপ্তাহিক বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল: অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলার উপযুক্ততা, পাকিস্তানের সংখ্যগরিষ্ঠ জনগনের ভাষা হিসাবে এর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি ।

তারা পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের বার্ষিক সম্মেলন করেছিলেন কুষ্টিয়াতে। পরিমল থিয়েটারে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্থাপতি আবুল কাশেম, সৈনিক পত্রিকা সম্পাদক অধ্যাপক আব্দূল গফুর, সাহিত্যিক অধ্যপক শাহেদ আলী, ফরিদ আহমেদ, দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, এ্যাডঃ ফরমান উল্লাহ খান , শ্রমিক নেতা সোলাইমান খান প্রমূখ নেত্ববৃন্দ । সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী খালিদ হোসেন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ পুলিশের গুলিতে শহীদ সালাম, বরকত, শফিক, জব্বার এদের আত্মোত্যাগের খবরে কুষ্টিয়াতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় । এই সংগ্রামী অভিযান গতিশীল রাখতে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে এক সর্ব দলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির ব্যাক্তিদের তালিকাটি নিম্নে দেওয়া হল:

সভাপতি : আব্দুল হক(ব্যারিস্টার) সেক্রেটারি : জুলফিকার হায়দার সদস্যরা হলেন: নজমউদ্দিন আহমেদ, খালেকুজ্জামান, দেওয়ান আহমেদ

সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেদিন কুষ্টিয়ায় স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মোহিনি মিলস, যজ্ঞেশ্বর কারখানা প্রভৃতি অচল হয়ে পড়েছিল । সারা শহর মিছিল মিটিংয়ে উদ্বেল হয়েছিল। কুষ্টিয়ার এক কৃতিসন্তান অবিভক্ত বাংলার সাবেক মন্ত্রী প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য শামসুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এবং প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে পরিষদে ভাষণ দিয়ে ছিলেন।

সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্ম তৎপরতায় রাষ্ট ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কুষ্টিয়াতে এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল যে কুষ্টিয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব এহিয়া খান চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কুষ্টিয়া সফরের সময় কালো পতাকা সংবর্ধনা হবার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি জনাব আব্দুল হক সাহেবকে মেহেরপুরে এক্সটার্ন করেন এবং কুষ্টিয়ার তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা এ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদকে স্বগৃহে অন্তরীণ করেন ।

পরবর্তিতে তমদ্দুন মজলিসের সদস্যরা বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্বে জড়িয়ে পরেন। এর ফলে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন ও তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে ভাষা সৈনিকদের অনেকেই আজ আর নেই, অনেকে অবসর জীবন যাপন করছেন সরকারী কিংবা বেসরকারী পর্যায়ে তাদেরকে আর স্মরণ করা হয়না। তবে এ নিয়ে তাঁদের কোন আক্ষেপ নেই। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়েই তাঁরা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী হয়েছিলেন।

সাপ্তাহিক দেশব্রতী পত্রিকার ১৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যায় ভাষা সৈনিক নজম উদ্দিন আহমেদ এর একটি স্বাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় । এই স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাষ্টভাষা আন্দোলন হয়েছিল তা পূর্ণ বাসত্মবায়িত হয়নি এটা দুঃখজনক । দেশে আজ অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে । দেশীয় সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমদের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। এজন্য তিনি সাংস্কৃতিক চর্চা এবং প্রচারকে আরও বাড়িয়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দেন।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা : ভাষাসৈনিক জনাব নজমউদ্দিন আহমেদ এবং কুষ্টিয়া পৌরসভা ব্লগস্পট

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ