আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন শাহ ফকির - মুহম্মদ আবদুল হাই
লালন শাহ ফকির - মুহম্মদ আবদুল হাই

বাংলার বাউল কবিদের মধ্যে লালন শাহ্‌ই সুবিখ্যাত। তার সমকক্ষ বাউল কবি কি হিন্দু কি মুসলমান কোন সম্প্রদায়ের মধ্যেই দেখা যায় না। আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বলে তাঁকে ফকীর বলা হয়। তিনি তাঁর ভক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং বাংলা সাহিত্যে লালন ফকীর নামেই সমধিক পরিচিত।

বাংলার লোককবিদের মধ্যে লালন ফকির যত বড় কবি, ঠিক সে পরিমাণেই তাঁর নাম, জাতি-ধর্ম, জন্মস্থান ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আজও কোন গবেষক এ সম্পর্কে কোন অকাট্য স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁর জাতি-ধর্ম ও জন্মস্থান সম্পর্কে যে সব মত প্রচলিত আছে একে একে আমরা তা আলোচনা করছি।

কেউ বলেন লালন হিন্দু, কেউ বলেন মুসলমান ’বাংলার বাউল ও বাউলগান’ (১৩৬৪) রচয়িতা উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে ”পূর্বতন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) মহকুমার অন্তর্গত কুমারখালী থানার অধীন হইতে পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গড়াই নদীর তীর ভাঁড়ারা গ্রামে লালনের জন্ম হয়”।

অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ক্ষিতিমোহন সেন প্রমুখ তাঁর পূর্ববর্তী জীবনীকার লালনকে হিন্দু কুলোদ্ভব বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর জন্মগত পূর্বনাম লালনচন্দ্র। বংশগত উপাধি কেউ বলেন রায়, কেউ বলেন কর, কেউ বলেন দাস। সম্ভবতঃ তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন।

লালনের জন্মমৃত্যুর তারিখ নিয়েও কম বিতর্ক নেই। অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে তাঁর জন্ম ১১৮১ সালে ইংরেজি ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে; অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন সাহেবের মতে ১১৮২ সাল মোতাবেক ইংরেজি ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দ।

লালনের মৃত্যুর তারিখ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে ১২৯৭ সাল, ১ লা কার্তিক, ইংরেজি ১৮৯০, ১৭ ই অক্টোবর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১১৬ বৎসর। মনসুর উদ্দিন সাহেবের মতে ১২৯৯ সাল অর্থ্যাৎ ইংরেজি ১৮৯১ খৃষ্টাব্দ।

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং মনসুর উদ্দিন সাহেবের মধ্যে লালনের জন্ম-মৃত্যুর তারিখের যে ব্যবধান তা এমন কিছু নয়। আমার ও মনসুরউদ্দিন সাহেবের যুগ্মসম্পাদনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত ’হারামণি’ ৫ম খন্ডে (১৯৬১) আমিও লালনের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ যথাক্রমে ১৭৭৪ ও ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ বলে গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে সকলে একমত যে, লালন দীর্ঘজীবী ছিলেন।

তিনি হিন্দু কি মুসলমান ছিলেন তা নিয়ে তর্ক করা বৃথা। তার কারণ লালন বাহ্যতঃ হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে বাঁচতে চাননি, জীবণ-ধারণও করেননি। তিনি ছিলেন সাধক ও মরমী কবি। সাহজ কথায় বাউল কবি হিসেবেই তাঁর খ্যাতি।

সহজিয়া নাথপন্থ, মরমীবাদ ও বাউল প্রভৃতি শব্দের ঐতিহ্য এবং ব্যাখ্যা অত্যন্ত জটিল। মধ্যযুগে বৌদ্ধধর্মের বিকৃতি এবং হীনযান এবং মহাযান প্রভৃতি শাখার ভাঙনের কালে এদেশের নি¤œ শ্রেণীর অধিবাসীদের মধ্যে নানা গুহ্য সাধনপন্থী লোকের সৃষ্টি হয়। উন্নত ভাবাদর্শ ও মহৎ চিন্তা কল্পনার অধিকারী এরা ছিল না। এসব নেড়ানেড়ীর দল গ্রামবাংলার সমাজের নীচের তলায় অত্যন্ত কদর্যভাবে জীবনযাপন করত। বৈদিক, বৌদ্ধ প্রভূতি বিভিন্ন সাধনার ধারা মিলে মিশে এসব বিকৃত রুচির মত ও পথ গড়ে উঠেছিল। কিন্তুু এর ফলে সংস্কৃতি সাধনার ক্ষেত্রে কিছু যে ভালো ফল ফলেনি তা নয়। বাউল মতবাদও এমনই এক সাধনার ফল।

বাউল ধর্ম সাধনা একটি গুহ্য ক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনার সহিত বিশেষ সাদৃশ্য আছে। মধ্যযুগে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ’বাউল’ শব্দটি ’বাহ্যজ্ঞানহীন’ ’উন্মাদ’ ’স্বাভাবিক চেতনাশূন্য’ প্রভূতি অর্থে ব্যবহৃত হ’য়ে এসেছে। অনেকে ’বাউল’ শব্দটিকে ’বাতুল’ শব্দের প্রাকৃতরুপ ব’লে মনে করেছেন। কেউ কেউ ’বাউল’কে আকুল শব্দজাত ’আউল’ শব্দেরও সমার্থবোধক বলতে চান। তারা মনে করেন ’বাউল’ সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান সাধকরা ’আউল’ বা আউলিয়া হিসাবে গণ্য।

বাউল সাধকদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই দেখা যায়। মুসলমান বাউলেরা বে-শরাহ ফকীর। ’বে-শরাহ’ অর্থ শরীয়ত বা আনুষ্ঠানিক ইসলাম ধর্ম বহির্ভূত। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত সংক্রান্ত বিধি বিধান এরা পালন করেন না। বাউলেরা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মরমী। তাঁরা আধ্যাত্ববাদী। মুসলমান বাউলদের উপর সুফী প্রভাব পড়ায় তাঁরা আরও বিশেষভাবে তত্ত্বান্বেষী। তাঁরা সচেতনভাবে নিজেকে জানার প্রয়াস করেন এবং নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে আল্লাহকে জানতে চান।

লালন এমনি এক সিদ্ধ বাউলকবি। তিনি যে লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক ছিলেন এমন কথা কেউই বলেন না। তিনি উম্মি বা নিরক্ষর ছিলেন। তার সাধারণ জ্ঞান ছিল প্রখর। হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্য সম্পর্কে ভূয়োদর্শনজাত জ্ঞানের তিনি অধিকারী ছিলেন। অন্তদৃর্ষ্টির সাহায্যে তিনি তত্ত্বজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। সপ্তাদশ শতাব্দীর শিক্ষিত মুসলমান কবি আলাওল এবং একালের কবি নজরুল ইসলামের মতো হিন্দু ও মুসলমান কৃষ্টির সারবস্তু তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর বাণী, গান ও উক্তিতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ও জীবণধারার ঐতিহ্যগত ছাপ সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। প্রাক-আজাদীর যুগের বাংলাদেশে বিশেষভাবে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে সমাজের নীচের তলার হিন্দু ও মুসলিম সাধকেরা হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির একটি যে মিলন সাধনের ক্ষেত্র রচনা করে চলেছিলেন লালন প্রমুখ বাউল সাধকের গানে তাঁর আশ্চর্য স্বীকৃতি আছে।

এ ছাড়াও একালের কবি নজরুল ইসলাম যেমন পৃথকভাবে হিন্দু সংস্কৃতি অবলম্বন ক’রে কালিকাদেবী সম্পর্কে শ্যামা সংগীত ও সাধুকীর্তনাদি রচনা করেছেন আবার ইসলাম ভাবাদর্শ সম্বলিত মুসলিম ইতিহাসের ছোটখাট ঘটনাকে অসংখ্য গানে ও গজলে ধরে নিয়ে গেছেন। বাউল কবি লালন ফকিরও তেমনি হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে গান রচনা করেছেন।

লালন ফকির সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তত্ত্বজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন বলে জীবন ও জগতের পরিচিত পরিবেশ সম্পর্কে গভীর ধ্যান-ধারণাজাত উপলদ্ধির কথা অত্যন্ত সহজ সাবলীল ভঙ্গীতে বলতে পারতেন। তাঁর কাছে ’মানুষ’ই ছিল সব চাইতে বড়। চন্ডীদাসের ’সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’ এ অনুভূতি সহজ ভঙ্গীতে লালনের গানটিতে ধরা পড়েছে ;

এমন মানবজনম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।

অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছইু নাই
দেব দেবতাগণ
করে আরাধন
জন্ম দিতে মানবে।।

কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মন রে পেয়েছে এই মানবতরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়
যেন ভারা না ডোবে।।

এই মানুষে হবে মাধুর্য ভজন
তাই তো মানুষরুপ গঠলে নিরজ্ঞন
এবার ঠকলে আর
না দেখি কিনার
অধীর লালন তাই ভাবে।।



বাউলেরা মানুষকে পূজা করেন না কিন্তু মানুষকে জানাই তাঁদের প্রধান সাধনা। বাউল খোদাকে ছেড়ে খোদার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের রহস্য উৎঘাটনে ব্যপৃত। তাঁর সে রহস্য উৎঘাটন করেন এ দেহের সাধনার ভেতর দিয়ে। তাঁদের মতে যা আছে ব্রহ্মান্ডে, তা আছে দেহভান্ডে। সুতরাং দেহকে জরিপ ক’রেই তাঁরা তাদের দেহের অধিকারী মনের মানুষ মনের মাঝে করেন অন্মেষণ। তাঁদের মনের মানুষ, আলোকের মানুষ। ’আল্লাহ’ বিশ্বপ্রভূ এ মানবদেহের মধ্যেই বাস করেন। খুজে ফিরে তাঁকে শুধু ধরতে পারা চাই। বাউল শ্রেষ্ঠ লালন এ সম্পর্কে অপরুপ কথা বলেছেন ;

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।

আট কুঠরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝলকা টাকা
তার উপরে আছে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।।

মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাচা পড়বে খসে
লালন কয়, খাঁচা খুলে
সে পাখি কোনখানে পালায়।।



রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও এ অনুভ’তির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই :

সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর
আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধূর।



বাউলকবি হিসাবে লালন ফকির একদিকে যেমন দেহের সাধনা করেছেন, সুফী প্রভাববশত অন্যদিকে তেমনি আল্লাহকে পাবার আশায় মুর্শিদেরও আরোধনা করেছেন।

এ মুর্শিদ তাঁর কাছে ’ইনসানে কামেল’ হযরত মুহাম্মদ (দঃ)। সুফী সাধনায় পীর বা গুরুবাদের প্রয়োজন হয় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য। যথারীতি খোদাপ্রাপ্তির সাধনা করতে পারলে দেখা যায় আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ দেহের ঘাড়ের শিরা উপশিরার চেয়েও তার নিকটবর্তী। কিন্তু তা উপলদ্ধি করার শক্তি অর্জন করতে হ’লে গুরু পীর তথা মুর্শিদ লাভ করতে হয়। লালন তাঁর সাধনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মুর্শিদরুপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কাছে ’আহাদ’ (এক আল্লাহ) এবং ’আহমদ’ (যিনি প্রশংসিত) অর্থ্যাৎ নবীকে ধরতে পারলে খোদাকে পাওয়া দুষ্কর হয় না ;

আকার কি নিরাকার সাঁই রাব্বানা
আহাদের আহমদের বিচার হৈলে যায় জানা।।

হায় রে আহমদ নামেতে দেখি
মিম হরফে লেখে নবী
মিম পেলে আহাদ বাকী
আহমদ নাম থাকে কিনা।।

খুঁজিতে বান্দার দেহে
খোদা সে রয় লুকাইয়ে
আহাদে মিম বসাইলে
আহমদ নাম হয় কিনা।।



অর্থ্যাৎ খোদা আকার কি নিরাকার এখানে তা ভেবে দেখতে বলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কোন হরফের কি তত্ত্ব তাও জানতে হবে। হযরত মুহাম্মদ (দঃ) যিনি খোদার নবী তাঁর অপর নাম আহমদ। আহমদ শব্দটা লিখতে আলেফ, হে, মিম ও দাল এ চারটি হরফের প্রয়োজন হয় এবং এর ভিতর থেকে মিম হরফটি বাদ দিলে পাওয়া যায় আহাদ অর্থ্যাৎ খোদাকে ; আবার আহাদ শব্দটির মধ্যে মিম হরফটি যোগ করলে পাওয়া যায় হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে।

লালন সুফী মতবাদের দ্বারা প্রভাবাম্বিত হলেও যথার্থ সুফী ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। তিনি মূলত বাউল তত্ত্ববাদী তথা মরমী কবি ছিলেন। অন্য কথায় তিনি তত্ত্বরসিক বা Mysitc ছিলেন। খোদাকে পাই পাই করে যেন পাচ্ছেন না। তাঁকে জীবনব্যাপী সন্ধান করাই যেন তাঁর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে - নিম্নের পাদগুলোর মতো বহুপদে তার পরিচয় বিবৃতঃ-

কোথা আছে রে দীন দরদী সাঁই
চেতন- গুরুর সঙ্গ লয়ে খবর কর ভাই।
চক্ষু আঁধার দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়
কি রঙ্গ সাঁই দেখে দে সদাই
বসে নিগম ঠাঁই।

এখনো না দেখলাম যারে
চিনবো তা’রে কেমন ক’রে?
ভাগ্যের আখেরে তারে
দেখতে যদি পাই।

সুমঝে ভবে সাধনা করো
নিকটে ধন পেতে পারে।
লালন কয় নিজ মোকাম ধোড়ো
বহু দূরে নাই।

অথবা,
আমি একদিনও দেখলাম না তারে
আমার বাড়ী আছে আরশীনগর
(ও) এক পড়শী বসত করে।
গ্রাম বেড়িয়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী
পারে।

আমি বাঞ্জা করি
দেখবো তারি
আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে।।

বলবো কি সেই পড়শীর কথা
ও তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে।

ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।।

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো
আমার যম যাতনা যেতো দূরে।

আবার সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।



লালন ফকীর এ ধরনের হাজার হাজার গান রচনা করেছেন। এ সব গান তিনি যে বসে লিখতেন তাও নয়। তাঁর অধিকাংশ গানই অনুভূতি লদ্ধ। তিনি গান গাইতেন আর তাঁর ভক্ত ও শিষ্যেরা সে গান মুখস্ত করে নিত, টুকে রাখতো। গ্রাম্য গায়েনদের মুখে মুখে সমগ্র পূর্ববাংলা এমনকি পশ্চিম বাংলাতেও লালনের গান ছড়িয়ে গেছে। নদীয়া, যশোর, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি মধ্য ও নি¤œবঙ্গের জেলাগুলোতেই লালনের গানের প্রাধান্য দেখা যায়। লালন শিষ্য-প্রশিষ্য ও ভক্ত সম্প্রদায়ের মুখে গীত হ’তে হ’তে তাঁর গান নানাভাবে বিকৃত হয়েছে। এ বিকৃতি যে শুধু উচ্চারণঘটিত তা নয়, অনেক সময় ঠিকমতো মুখস্ত করতে না পেরে গায়েনেরা তাতে হয়তো নিজে নিজে শব্দও যোজনা করেছে। আবার এক মুখ থেকে অন্য মুখে যেতে যেতেও বহু গান পরিবর্তিত হয়েছে। খ্যাতিহীন কোন গায়ক আতœতৃপ্তি লাভ করার জন্য গান রচনা করে লালনের ভনিতা দিয়ে বসেছে এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।

সে যা হোক লালনের গানগুলো লোকমুখে গীত হ’তে হ’তে লোকগীতির মতো এখন জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আউল, বাউল প্রভৃতি শাখার লোককবির অভাব নেই। পাগলা কানাই, মদন বাউল, গগন হরকরা, বিশা ভূঁইমালী, শীতালং শাহ প্রমূখ অগনিত লোককবির গান আমরা জানি। একালে যেমন তথ্যানুসন্ধান স্পৃহা বেড়েছে তাতে আরও লোককবি আবিস্কৃত হচ্ছে। কিছু কিছু করে তাঁদের গানও উদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু লালনের গান যতই বিকৃত হোক বিজ্ঞ পাঠকের কাছে তার কোনটা আসল কোনটা নকল তা সহজেই ধরা পড়ে। তার কারণ লালনের মতো দিব্যদৃষ্টি আর কোন বাউল তথা লোককবির মধ্যে ছিল না। কতকালের কোন সাধনায় তাঁর অন্তর কিভাবে যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তা বাইরের লোকের জানবার কথা নয়, কিন্তু তাঁর লোকোত্তোর চেতনা সমৃদ্ধ হৃদয় থেকে গভীর ধ্যান ও জ্ঞানের কথা, ইহকাল, পরকাল, জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় মানুষ এবং ¯্রষ্টা সম্পর্কিত বিবিধ জটিল তত্ত্বও সহস্য কথা কত সাবলীল রচনা ভঙ্গীতে যে ধরা পড়েছে তাঁর রচিত গানগুলোর সঙ্গে নিবিড় পরিচয় থাকলে তা সহজেই বোঝা যায়। তাঁতে তাই তত্ত্বজ্ঞানী মহাকবি বলতে হয়। সহজ সরল বাংলা শব্দের মধ্যে যে কত যে রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে তাঁর গানের শব্দ প্রয়োগ ও অনায়াস বয়ন কুশলতাই সে সাক্ষ্য বহন করছে। এমন ঝরঝরে, নির্ভার তদ্ভব শব্দ প্রয়োগের কারুকলা আর কোন লোককবির গানে দেখা যায় না। লালন তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্ব ও পরবর্তী কালের অন্যান্য লোককবি থেকে এখানেই বিশিষ্টতার দাবী করেন। সেইজন্য লালন শ্রেষ্ঠ বাউল ও লোককবি।

তাঁর আরবী ফার্সি শব্দের ব্যবহার কোরানের জ্ঞান এবং হিন্দু পুরানের যথেচ্ছ প্রয়োগ ক্ষমতা দেখলে বিস্মিত হতে হয় এবং তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন একথা বিশ্বাস হয় না।

(তৎকালীন) পূর্ব পাকিস্তান সরকার ছেঁওড়িয়ায় লালনের আশ্রমে একটি গবেষণা পাঠাগার নির্মাণ করে বৃদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। আশা করা যায় এখানে অদূর ভবিষ্যতে লালনের গান সংগৃহীত হবে - তাঁর সম্পর্কে গবেষণা হবে। এর ফলে ব্যপকভাবে তথ্য সংগৃহীত হ’লে লালনের কাব্য প্রতিভা এবং বাংলাদেশের সাহিত্যে এমনকি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে তার দানের পূর্ণ স্বরুপ এবং তাঁর চিন্তা ভাবনা ধর্মমত ও জীবণাদর্শের তথ্যবহুল একটি সমগ্রিক ছবি পাওয়া যাবে।

যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন তিনি যে একজন নগন্য লোককাবি হিসাবেই থাকবেন না নয়। এযাবৎ বিভিন্ন গবেষকের চেষ্টায় এবং তাঁর গান থেকে আমরা যা জানি তাতেও তিনি শক্তিমান ও শ্রেষ্ঠ বাউল কবি হিসেবেই বাংলা ভাষাভাষী জন সাধারণের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর কবিতা ও গানই তাঁকে জানার সবচেয়ে বড় উপাদান। এগুলো শুনলে তিনি হিন্দু কি মুসলমান, তাঁর জন্মস্থান কুষ্টিয়া জেলার ভাড়ারা গ্রামে না যশোরের কুলবেড়ে হরিশপুর এসব কোন কথা মনে আসে না। তাঁর দিব্যজ্ঞান রহস্য রসিকতা এবং আধ্যাত্বিক অনুভূতির স্বরুপ লক্ষ্য করে আমরা বিস্মিত হয় আর তাঁর রচনা শৈলীর অত্যাশ্চর্য সরলতায় হই মুগ্ধ। তখন অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন সত্যদ্রষ্টা এক মহান কবি বলেই আমরা তাঁকে জানতে পারি।

লালন যে একজন মহান ও শ্রেষ্ঠ বাউল কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথও তাঁর স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। বৃদ্ধ লালনের সঙ্গে তরুণ রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল এবং তিনি লালনের ভাবসাধনার দ্বারা যথেষ্ঠ প্রভাবাম্বিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির মধ্যে বাউলের ধর্মসাধনা বৈশিষ্ট্যেও সমর্থন পাওয়া যায় - ”মানুষের দেবতা মানুষের ’মনের মানুষ”। জ্ঞানে, কর্মে, ভাবে যে পরিমাণে সত্য হই সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে পাই। অন্তর বিকার ঘটলে সেই আমার আপন মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাইনে। মানুষের কিছু দূর্গতি আছে, সেই আপন মনের মানুষকে হারিয়ে তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে অর্থ্যাৎ আপনাকেই পার ক’রে দিয়ে। আপনাকে তখন টাকায় দেখি, খ্যাতিতে দেখি, ভোগের আয়োজনে দেখি। এই নিয়েই তো মানুষের যত বিবাদ. যত কান্না। সেই বাইরে বিক্ষিপ্ত আপনহারা মানুষের বিলাপগান একদিন শুনেছিলাম পথিক ভিখারীর মুখে :

আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে,
হারায়ে সেই মনের মানুষে তার উদ্দেশ্য
দেশ -বিদেশ বেড়াই ঘুরে।



সেই নিরক্ষর গাঁয়ের লোকের মুখেই শুনেছিলাম :

তোরই ভিতর অতল সাগর।



সেই পাগলই গেয়েছিল :

মনের মধ্যে মনের মানুষ কর অন্বেষণ।



সেই অন্বেষণেরই প্রার্থনা বেজে আছে; ” আবিরাবীর্য এধি - পরম মানুষের বিরাটরুপে যার স্বতঃপ্রকাশ আমারই মধ্যে তার প্রকাশ স্বার্থক হোক।

বাউল কবিদের মধ্যমণি লালন শাহ ফকিরের উপর রবীন্দ্রনাখের দৃষ্টি পড়েছিল। তিনি তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর ভাবধারায়ও যে কিছু প্রভাবান্বিত হন নি এমন নয়। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, গীতালি ও গীতমালা প্রভৃতি সংগীতাব্য কাব্যগুলোতে লালনের আধ্যাত্বিকতার সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্বিকতারও একটি সগোত্রতা লক্ষ্য করা যায়। এ সগোত্রতা অবশ্য প্রভাবজাত ততটা নয়, যত টা চিন্তা ও ভাবসাধনার ঐক্যজাত।

তবে একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথ লালন সম্পর্কে কৌতুহলী হয়েছিলেন এবং শ্রেষ্ঠ বাউল কবি হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই তাঁর প্রতি বাঙ্গালী কাব্যমোদী ও শিক্ষিত জনসাধারণের বিশেষভাবে দৃষ্টি পড়ে। তার ফলে দীর্ঘকাল ধরে আলোচিত হ’তে হ’তে তিনি তাঁর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন। নইলে কতকাল যে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেন, বলা যায় না।

কুষ্টিয়ার ছেউরিয়া অঞ্চল রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর মধ্যে ছিল। শোনা যায় তিনিই সচেষ্ট হ’য়ে ছেউরিয়ায় লালনের কবরটি বাঁধিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.