এই সময়ে বহুলোক টাকা-পয়সা ও ফলমূল আনিয়া তাঁহাকে উপহার দিত। বৎসরে ফাল্লুন মাসে তিনি একটি ভাগুরা করিতেন। পাঁচ সাত হাজার লোক এখানে আসিয়া আহার করিত এবং গান গাহিত। এখানে এই ভাগুরার একটি বিবরণ দিই। ইহার আর এক নাম সাধুসেবা। আজও বঙ্গদেশের স্থানে স্থানে বিশেষ করিয়া নদীয়া (কুষ্টিয়া) যশোর ও পাবনায় অংশবিশেষে এই সাধু সেবা হয়। ইহাতে প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের ফকিরেরা নিমন্ত্রিত হন। সাধারণত ফকির ছাড়া আর কারও বাড়িতে সাধুসেবা হয় না, তবে কোনো ফকিরের শিষ্য হইলে কেহ সাধুসেবা করিতে পারেন।
সাধারণত আম-কাঁঠালের বাগানের ভিতর একটি বিস্তীর্ণ স্থান পরিস্কার করা হয়। তাহাঁতে সারি বাঁধিয়া ছোট ছোট বিছানা করিয়া দেওয়া হয়। মাদুরের উপর কাঁথা ও বালিশ এই বিছানার সরঞ্জাম। ইহাকে “গদি” কহে। এই গদির উপরে সাধুরা তাহাঁদের শিষ্যগনের সহিত বসিয়া ধর্মালাপ ও গান গাহিয়া থাকেন। সাধারণত বৈকালবেলায়ই সাধুসেবা আরম্ভ হয়। এক এক দল সাধু ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম হইতে সভায় আসিয়া সমস্বরে ‘আলেক’ এই শব্দ উচ্চারণ করিয়া থাকেন। ইহার অর্থ, আল্লা এক। তারপর তাঁহারা যোগ্যতানুসারে সকলকে প্রণাম ও অভিবাদন করিয়া নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করেন। সন্ধ্যাবেলা ‘চাইলপানি’ খাইয়া সাধুরা গান করিতে আরম্ভ করেন।
যদিও বিভিন্ন দলে বিভিন্ন বিভিন্ন গান হইয়া থাকে কিন্তু সকল গানের ভিতরই একটা ধারাবাহিকতা আছে। এক ভাবের গানই সকলকে গাহিতে হয়। এইসব গানের মধ্যে সময় সময় পাল্লাও লাগিয়া যায়। আজকাল কুষ্টিয়া জেলায় পাঞ্জুশার শিষ্যদের সহিত লালনের শিষ্যদের প্রায়ই পাল্লা হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য যে ইহারা স্ব স্ব গুরুর গানটি গাহিয়া থাকে। আর ইহাদের গানগুলি এরূপভাবে তৈরি যে একজনের গান দিয়া আরেকজনের প্রত্যেকটি গানের উত্তর দেওয়া যায়। এইরূপ গান গাহিতে গাহিতে যখন প্রায় রাত্র দুইটা বাজে তখন একটি লোকে “আলেক” এই শব্দ উচ্চারণ করে, আর সমস্ত গান বাদ্যযন্ত্রের মতো থামিয়া যায়। তখন ফকিরেরা আহার করিয়া আপনা-আপন গদিতে ঘুমাইয়া থাকে।
পরদিন সকালে গোষ্ঠগান আরম্ভ হয়। তারপর সকলে বাল্যভোজন সমাপ্ত করিয়া গান আরম্ভ করে। মধ্যাহ্ন আহারের পর ফকিরেরা যোগ্যতা অনুসারে কিছু কিছু ভিক্ষা পায়।
লালন যেসব সাধুসেবা করিতেন তাহাঁতে তখনকার দিনেও তাঁর তিন চার শত টাকা ব্যয় হইত।
গ্রামের লোকেরা তাঁহাকে সবিশেষ ভক্তি করিত। তাঁদের সুখে দুঃখে তিনি চিরসঙ্গী ছিলেন। তিন চারখানা গ্রামের মধ্যে কারও অসুখ হইলে তিনি ঔষধ দিয়া এবং মন্ত্র প্রয়োগ করিয়া তাঁহার উপশম করিতেন। এইজন্যই বুঝি তিনি সার-কৌমুদি বলিয়া একখানা কবিরাজী সংগ্রহ পুস্তক লিখিয়াছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি গ্রামের লোকদের তাবিজ ও কবচ দিতেন। লালনের স্বহস্তে লেখা একটুকরা কাগজের একটি মাদুলি আমরা পাইয়াছি। তাঁর সচ্চরিত ও নম্র ব্যবহার কি ধনী কি নির্ধন সকলকেই আকর্ষণ করিত। তিনি জীবনে অতি সংযমী ছিলেন। যদিও তিনি আশ্রমে সস্ত্রীক বাস করিতেন তথাপি স্বামী-স্ত্রীতে কোনোরূপ দৈহিক সম্নন্ধ ছিল না বলিয়া শুনা যায়।
“আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন। সম্প্রদায়ের মতানুসারে তাঁহার কোনো সন্তান-সন্ততি হয় নাই।” - হিতকরী
আরো আছে চলিবে...