আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

প্যারীসুন্দরী - নীল বিদ্রোহের অবিস্মরণীয় চরিত্র
প্যারীসুন্দরী - নীল বিদ্রোহের অবিস্মরণীয় চরিত্র

প্যারীসুন্দরী, নীল বিদ্রোহের অবিস্মরণীয় চরিত্র। স্বদেশ প্রেমের অনির্বান শিখাসম এক নাম। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার (বর্তমান কুষ্টিয়ার) মিরপুর উপজেলার সদরপুরের জমিদার রামানন্দ সিংহের কনিষ্ঠ কন্যা। আজীবন লড়েছেন মাটি ও মানুষের পক্ষে, দেশমাতৃকার স্বার্থে। অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও লাঠিয়ালদের নিয়ে তাঁর সংগ্রাম কিংবদন্তিতুল্য। প্রতিপক্ষ ছিল নীলকর টমাস আইভান কেনি, সংক্ষেপে টি আই কেনি। ফার্গুসন, শেলি ক্রফোর্ড, স্টিফেনসন, সিম্পসন প্রমুখ অত্যাচারী নীলকরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর নাম।

নীল কমিশনের সাক্ষ্যে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন বলেছিলেন, ‘খুন, জখম, দাঙ্গা, ডাকাতি, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মানুষ চুরি প্রভৃতি এমন কোনো অপরাধ নেই, যা নীলকরেরা করেনি।’ কেনির অত্যাচার ছিল এদের চেয়েও মাত্রাতিরিক্ত। যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান প্যারীসুন্দরী।

কেনির কাচারি ছিল কুষ্টিয়া শহরের বেকিদালানে, কুঠি ছিল অনতিদূর শালঘর মধুয়ায়।

প্যারীসুন্দরীর দেশপ্রেম, প্রজাহিতৈষণার বিপরীতে কেনির অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনী ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে দেখা যায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত দ্য হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায়ও এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। সবিশেষ রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের উদাসীন পথিকের মনের কথায়। প্যারীসুন্দরীর সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত ওই গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে, ‘আমার লাঠিয়াল কুঠি লুট করিয়াছে, দশজনের মুখে এ কথা শুনিয়া আমার সুখবোধ হইতেছে। আমি বাঙ্গালীর মেয়ে, সাহেবের কুঠী লুটিয়া আনিয়াছি, ইহা অপেক্ষা সুখের বিষয় আর কি আছে!’

নীলকর কেনি ও জমিদারকন্যা প্যারীসুন্দরীর লড়াই ছিল নাটকীয়তায় পূর্ণ, যা কল্পনার গল্প-উপন্যাস-নাটকের কাহিনীকেও হার মানায়। ধূর্ততা, শঠতার ফাঁদের বিপরীতে বীরোচিত প্রজ্ঞা ও নৈপুণ্যে মাথা উঁচু করে দেশের জন্য সর্বস্ব দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করার ব্রত, বাংলার নীল বিদ্রোহের ইতিহাসে স্বদেশ প্রেমের অনির্বান শিখার মর্যাদা পেয়েছে।

প্রজাবান্ধব প্যারীসুন্দরীর জীবন ও কর্ম দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার মতো, অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার মতো। যেমন, ‘যে ব্যক্তি যে কোন কৌশলে কেনীর মাথা আমার নিকট আনিয়া দিবে, এই হাজার টাকার তোড়া আমি তাঁহার জন্য বাঁধিয়া রাখিলাম।...ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া বলিতেছি, সদরপুরের সমুদয় সম্পত্তি কেনীর জন্য রহিল।... দুরন্ত নীলকরের হস্ত হইতে প্রজাকে রক্ষা করিতে জীবন যায়, সেও আমার পণ। আমি আমার জীবনের জন্য একটুকুও ভাবি না। দেশের দুর্দ্দশা, নিরীহ প্রজার দুরবস্থার কথা শুনিয়া আমার প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে।’ প্যারীসুন্দরীর সঙ্গে সর্বস্ব হারানো জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। প্রতি বিঘা জমিতে নীল চাষে খরচ হতো ১০ টাকা, অথচ নীলকরেরা মূল্য দিত সাড়ে তিন টাকা। নদীয়ায় ১৭ হাজার ৬০০ বিঘা জমিতে ৭০০ মণ নীল উৎপন্ন হতো। এর মধ্যে কুষ্টিয়া ছিল প্রথম, যার নেপথ্য ক্রীড়নক ছিলেন নীলকর টি আই কেনি। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক বিনয় রায় তাঁর বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ল্যুই বোনদ অবিভক্ত বাংলায় প্রথম নীল চাষ শুরু করেন।’ ক্যারল ব¬ুম স্থাপন করেন প্রথম নীলকুঠি। পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদে ইউরোপিয়ানরা এ দেশে জমি কেনা ও নীল চাষের অনুমতি পায়।

কেনি ও প্যারীসুন্দরীর বিরোধের সূত্রপাত ভাড়ল- পোড়াদহ অঞ্চলের ধানের জমিতে জোরপূর্বক নীল চাষ করা নিয়ে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষক, প্রজা, চাষিরা প্যারী সুন্দরীর কাছে দিনের পর দিন প্রতিকারের জন্য নালিশ জানায়। তিনি নায়েব রামলোচনকে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়োগ ও আক্রমণের পরামর্শ দেন। কেনির বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হয়। ভাড়ল কুঠি লুণ্ঠিত হয়। কেনির অত্যাচার বৃদ্ধি পায়।

প্যারীসুন্দরী নতুন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কেনির কুঠিতে আক্রমণ করে। কেনি কুঠিতে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। মিসেস কেনি অজস্র কাঁচা টাকা ছড়িয়ে দিয়ে প্যারী সুন্দরীর লাঠিয়ালদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। কেনি প্যারী সুন্দরীর বিরুদ্ধে কুঠি লুটের মামলা করেন।

ভীত না হয়ে উল্টো, গর্ববোধ করেন প্যারী সুন্দরী। কেনির মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন এবং মিসেস কেনিকে বালা পরিয়ে বাঙালি বধূ সাজানোর অঙ্গীকার করেন। ক্ষিপ্ত হন কেনি। ঘোষণা করেন, যে প্যারী সুন্দরীকে তাঁর কাছে এনে দিতে পারবে, তাকে তিনি এক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন এবং প্যারী সুন্দরীকে গাউন পরিয়ে মেম সাজিয়ে তাঁর কুঠিতে রাখবেন। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি পুরস্কার ঘোষণা ও আক্রমণ। আবারও কেনির কুঠিতে আক্রমণ করে প্যারী বাহিনী। চতুর কেনি পালিয়ে বাঁচেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশও প্রাণে রক্ষা পায়। দারোগা মোহাম্মদ বক্স খুন হন। আবারও প্যারী সুন্দরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রহসনের বিচারে যাবতীয় জমিদারি ইংরেজ সরকার অধিকার করে। গরিব কৃষক, চাষি ও প্রজা নিয়ে অকূলে পড়েন প্যারী সুন্দরী। রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে জমিদারি ফেরত পান। কিন্তু তখন তিনি ঋণের ভারে জর্জরিত, ফলে জমিদারির বিরাট অংশ পত্তনি বন্দোবস্ত করে দেন। ড. আবুল আহসান চৌধুরী ‘প্যারীসুন্দরী নীল বিদ্রোহের বিস্মৃত নায়িকা’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘প্যারীসুন্দরী প্রজাদরদি, স্বদেশপ্রাণ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত এক অসামান্য জননেত্রী।’

অত্যাচারী কেনি নিজেই স্বীকার করেছেন, প্যারীসুন্দরী সব দিক থেকেই তাঁর চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর সাহস ও দেশপ্রেমের কাছে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত ও শঙ্কিত ছিলেন। যেমন- ‘স্ত্রী লোকের মধ্যে প্যারীসুন্দরীর নাম করিতেও ভয় হয়।’

স্মরিত হোক কিংবা না হোক, প্যারীসুন্দরী নীল বিদ্রোহের ইতিহাসে সংযোজন করেছেন স্বদেশপ্রেমের অনির্বান শিখা। যে ইতিহাসের ব্যাপ্তিকাল ১৮৪৯ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত।

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- ভয়েজ অফ বাংলাদেশ

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.