আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের অগ্রসৈনিক: মীর মশাররফ হোসেন

বহু প্রতিভার অধিকারী, মানব দরদী, সমাজ হিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নিকটবর্তী লাহিনী পাড়া গ্রামে বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন।

মীর মশাররফ হোসেন বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করেন। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের অগ্রদূত ও বাংলা গদ্যের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। মীর মশাররফ হোসেন তার বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি তার রচনাবলীর বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে রূপদান করেছেন। শৈশবে মীর মশাররফ হোসেন প্রথমে গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করেন, পরে কিছুদিন তিনি কুষ্টিয়া ইংরেজি স্কুলে এবং একবছর পদমদীর নবাব স্কুলে লেখাপড়া করেন। ফরিদপুরের পদমদী স্কুলে লেখাপড়ার সময় তিনি ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সম্ভবত: এর বেশি লেখাপড়ার সুযোগ তার ঘটেনি। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি কিছুদিন ফরিদপুরের পদমদী নবাব এস্টেটে এবং কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। পরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার জমিদারী এস্টেটে ম্যানেজারিতেই কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটে কাজের সময়টাকেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মনে করা হয়। কারণ এখান থেকেই তিনি সামাজিক ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ‘গ্রাম্য বার্তা’ সম্পাদক হরিণাথ মজুমদার ওরফে ‘কাঙাল হরিণাথ’ তার সাহিত্য গুরু ছিলেন। তৎকালীন তিনি এই ‘গ্রাম্য বার্তা’ এবং ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা দুটিতে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তার আগে বাংলা গদ্য সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলমান সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। আধুনিক যুগে মুসলমান সাহিত্যসেবীদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন অগ্রপথিক। তার সাহিত্য কর্ম পরবর্তীকালে বহু মুসলিম সাহিত্য সাধককে সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছিল।

অতি অল্প বয়সেই তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়। তার প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নবতী’ নামক উপন্যাস ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে রচিত ও প্রকাশিত হয়। তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘আমার জীবনী’ এটি ১২ খণ্ডে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। তার ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক আত্মজীবনীমূলক, ‘উদাস পথিকের মনের কথা’ তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনা। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা সর্ববৃহৎ উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রি:) তার শ্রেষ্ঠ রচনা। মীর মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদ সিন্ধু’ সেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রায় ১২০ বছর ধরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত আসন দখল করে আছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে দামেস্কের অধিপতি এজিদের বিরোধ ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে প্রধান ঘটনা। তার এই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রি:) তাকে বাঙালি পাঠক সমাজ তথা মুসলিম বিশ্ব চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

মীর মশাররফ হোসেন বাংলা কাব্য, প্রবন্ধ উপন্যাস রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের এক নব্য সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্য রস গ্রন্থ রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এ ছাড়া উপন্যাস ‘রতœাবতী’ থেকে ‘বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী’ প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সমাজ চিত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে তার প্রকাশিত, অপ্রকাশিত ৩৫ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।

উপন্যাস : রত্নবতী (২রা সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ), বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ), গাজী মিয়ার বস্তানী (১৮৯৮-১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) রস রচনা, তহমিনা (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ), বাঁধা খাতা (১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ), নিয়তি কি অবনতি (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ)।

নাটক : বসন্ত কুমারী (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), বেহুলা গীতা ভিনয় (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) গীতি নাট্য। নাটক : বসন্ত কুমারী (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), বেহুলা গীতা ভিনয় (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) গীতি নাট্য।

যাত্রা : টালা অভিয়ন (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)।

প্রহসন : এর উপায় কি? (১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ), ভাই ভাই এইতো চাই (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ), ফাঁস কাগজ (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ), একি? (১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দ)।

প্রবন্ধ : গো-জীবন (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ), মুসলমানের বাংলা শিক্ষা (১৯০৩-১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)। জীবনী : আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত ইউসুফ (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ), বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ)।

কাব্য : গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ), পঞ্চনারী (১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ), মৌলুদ শরীফ (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ) গদ্য, পদ্য।

ধর্মীয় গ্রন্থ : খোত্বা (১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ), প্রেম পরিজাত (১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত বেলালের জীবনী (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত ওমরের ধর্ম জীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত আমীর হামজার ধর্ম জীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), মদীনার গৌরব (১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ), মোসলেম বীরত্ব (১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ), বাজী মাৎ (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ), ইসলামের জয় (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) গদ্য ও পদ্য।

পত্র-পত্রিকা : ‘হিতকরী’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ‘আজিজন নেহার’ নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

মীর মশাররফ হোসেনের পূর্বে, বাংলা সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে তিনি আধুনিক সাহিত্যের প্রথম সার্থক সাধক ও স্রষ্টা। তার সাহিত্যের ভাষা প্রাণোচ্ছল ও বেগবান। আধুনিক যুগের মুসলিম বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিভার অধিকারী, সমাজ হিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন তার নানা কাব্য ও সাহিত্যে বাংলার মুসলমানকে প্রাচীন মুসলিম গৌরব ও ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, জীবনীকার ও শ্রেষ্ঠ সমাজ সচেতন ব্যক্তি।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, মুসলমান সমাজের পথ প্রদর্শক মীর মশাররফ হোসেন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রায় ৬৪ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তথ্য সুত্রঃ- দৈনিক নয়া দিগন্ত

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.