বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন দর্শনঃ অমূল্য নিধির বর্তমান ও নিহেতু প্রেম-সাধনা - শশী হক
লালন দর্শনঃ অমূল্য নিধির বর্তমান ও নিহেতু প্রেম-সাধনা - শশী হক

দেহের ক্ষুধা তৃষ্ণা কামনা বাসনা অস্বীকার করে না লালন, আবার দেহান্দ্রিয়ের দাস তাও হতে চায় না। অন্যদিকে মন তাঁর কাছে বশে না আসা তৃপ্তিহীন এক দুরন্ত সত্তা, চেনা যায় না বোঝা যায় না যারে। সারাক্ষন সেখানে চলে ছয় মন্ত্রীর কুকান্ডের শাসন। মন তাই পাতালগামী, বিষয় বিষে চঞ্চল। সকলেই অমৃত খোঁজে, কিন্তু তা কোথায়? বারবার শুধু বিষে জড়িয়ে পড়া। সাধক তাই বিষ ধরেই সাধন করে, তাকে অমৃতে পরিনত করার বাসনায়। দেহের সাধন ছাড়া মন কখনো শুদ্ধ হয়না, শান্ত হয়না, কেননা বিবাগি মন সে শুধু দেহেরই অধীন। তাই দেহকে নিহাজ করে জানতে হয়, তার মোকাম আর কুঠরিগুলি খবর নিতে হয়, বুঝতে হয় দেহ-নদীর ধারার রহস্য। দেহ-তত্ত্বের এইসব নিগুঢ় সাধনভজন সম্যক গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে লালন সাধক পারি দিতে চায় উত্তাল কামনদী। এক দূরহ যাত্রা।

রস-সাধনায় রেচক কুম্ভকের রহস্যই সব নয়, বস্তু রক্ষার অটলতাতেই কেবল সিদ্ধ হয়না ফকিরি। ঘোর তুফানে পড়লে এইসব বাঁধন-ছাঁদন গীরে-ফীরে সব ছুটে যায় ঢেউয়ের প্রবল ধাক্কায়। তখন শুধু কথার ব্যাবসা করা ছাড়া পথ থাকে না। তাই লালন, এই মহাসঙ্কট কালে, প্রেমকেই বলছে একমাত্র ভরসা, পারের রক্ষাকবচ। কিন্তু যে প্রেমের শক্তিতে নির্ভয়ে বিক্ষুব্ধ নদী অনায়াসে উজায় রসিক মহাজন তা যেসে নয়। এই প্রেম শুদ্ধ রাগে ডোবা। এই প্রেমের প্রেমী কামে থেকে নিস্কাম, নিহেতু ভাবরসে পাগল পারা। তারই এক দারুন উদাহরন দেখাতে লালন বারবার কৃষ্ণভাবনায় আত্মলীন গোপী-নারীগনের প্রেমের কথা বলেছে। তাঁর মতে গোপীগনই সেই অমুল্য নিধির অধিকারী, যেহেতু ভগবান কৃষ্ণ শুধু তাদের এই প্রেমের কাছেই বাঁধা, দায়ে কেনা।

বৈরাগ্যভাব বেদের বিধি
গুপিভাব অকৈতব নিধি।
ডুবল তাহে নিরবধী
রসিক জনা।।

যগীন্দ্র মনীন্দ্র যারে
পায়না যোগ ধিয়ান করে।
সেই কৃষ্ণ গোপীর দ্বারে
হয়েছে কেনা।।

পুর্বজন্মের পুণ্যের বিনিময়ে গোপী নারীগণ শুধুমাত্র কৃষ্ণদর্শনের আশায় দ্বাপর যুগে জন্ম নেয়। কৃষ্ণসুখই তাদের সুখ, এরজন্য কুলমান খুইয়ে আত্মসুখ বিসর্জন দিতে হলে তাও দেবে- এমনি মনোভাব। এই প্রেম নিহেতুকাম। একেই বারবার ভজতে বলেছে লালন। যার-মাঝে এই প্রেম অঙ্কুরিত, জীবসত্ত্বা থেকে উত্তরিত হয়ে সে এক অচিন আমার আমির খোঁজ পায়, হেতুশূন্য নিস্কাম এই অচিন আমিই সাঁই-রতন।

প্রেম মানুষের এক রহস্যময় অনুভূতি এবং ঐশ্বরিক দুটি গুন ‘মুক্ততা’ এবং ‘স্বাতন্ত্র’ এর প্রধান লক্ষন। তাই কান্টের ‘শুদ্ধ-প্রজ্ঞা’র সেই নৈতিক ও নান্দনিক নিষ্কামতা আনন্দময় হয়ে ওঠে শুধুমাত্র প্রেমেরি কারণে। অটলবিহারী কৃষ্ণ মানবলীলার স্বাদ পূর্ন করতে কলির যুগে জন্ম নেয় নদিয়ার গৌড় রূপে, শুধুমাত্র প্রেমের বাঞ্ছা মেটাতে- রাধার প্রেমের ঋণ শুধিতে। কেউ তারে বলে চৈতন্য কেউ গোরা বা গৌরাঙ্গ আবার কেউ বলে নিমাই। গোরার ভাবের অন্ত নাই।

ভাবে গৌড় হয়ে মত্ত
বাহু তুলে করে নৃত্য।
কোথায় হস্ত কোথায় পদ
ঠাওর নাই তাঁর অন্তরে।।

তাই লালন বলছে- গোরা এক নতুন আইন আনলো নদিয়ায়, বেদ-পুরান সব বাতিল করে শুধু শুদ্ধপ্রেমের মহিমা করলো প্রচার। এই প্রেম মানেনা কোন জাতপাত,ধর্মাধর্ম, রাখেনা কোন বিধিবিধান পাপপুণ্য জ্ঞান। সকল যুগের মাঝে গোরা এক দিব্যযুগ দেখায়।

বেদে যা নাই তাই যদি হয়
পুঁথি পড়ে কেন মরতে যাই।
লালন বলে ভজব সদাই
ওই গৌড় হরি।।

 

আয় কে যাবি গৌড়চাঁদের হাটে।।
তোরা আয় না মনে হয়ে খাঁটি
ধাক্কায় যেন যাসনে চটে ফেটে।।
সে কি আমার ক’বার কথা
আপন বেগে আপনি মরি।।

গৌড় এসে হৃদয়ে বসে
করলো আমার মন চুরি।।

কিবা গৌড় রূপ-লম্পটে
ধৈর্য-ডুরি দেয় গো কেটে
লজ্জা ভয় সব যায় ছুটে
যখন ওই রূপ মনে করি।।

নদিয়াবাসির প্রাণ কেঁপে ওঠে গৌড়-প্রেমের এই নব-তরঙ্গে। এ যেন সব ভেঙ্গেচুরে এক করে দিতে চায়। হিন্দু যবন মোল্লা পুরোহিত ভুলে মূঢ় ভেদাভেদ, গৌড়-প্রেমের হাটে মজে হলো আত্মহারা। কুলীন ব্রাহ্মণ অচ্ছুত চণ্ডালকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে- এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি, মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ সবাইকে তাই দেখালো। লালন তাই শেষপর্যন্ত এই গৌড়-প্রেমকেই মানছে কলির মানুষের মুক্তির শেষ উপায়, আর সব গৌণ করে দিয়ে। কারণ এই প্রেম বিপ্লবী, কুলনাশা সাম্যবাদী, এই প্রেম অসাধ্যের সাধ্যবিধান।

আজকের এই সভ্যতা, তার মানুষ, স্রষ্টার অপার কৃপার মধ্যে বাস করেও তাপিত-প্রাণ, ক্লিষ্ট, সুধাভাগ্যহারা। লালন বলছে যে মলয় পর্বতে যত বৃক্ষ জন্মে, সকলই পর্বতের সার(গুন) গ্রহন করে চন্দন-ঘ্রাণ প্রাপ্ত হলেও বাঁশ এর ব্যতিক্রম। প্রেমশূন্য চিত্তের দোষে চন্দনের গন্ধ বাঁশে আসে না। আজকের মানুষেরও তেমনি বাঁশের দশা। কেননা বর্তমান সভ্যতা কোন প্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। জ্ঞান কখনো পরিনত হয়নি ভাবে আর ভাব প্রেমে। তাই ক্রমাগত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষে মানুষে অনর্থক বিভেদ, লোভ, হিংসা আর হানাহানির দর্পিত ইতিহাস। জগত-মূলে বাহিত সাঁই নিরঞ্জনের নুর-শক্তিকে ভোগের পথে বেশুমার খরচ করে ক্ষুদ্র জ্ঞান আর অহঙ্কার নিয়ে অন্ধ যেন আজ মানুষ। কারণ প্রেম পায়না যে চোখ তার মনি ঘোলা, ঠুসি পড়া। তাইত আজো এতো জ্ঞানের পরেও, কুরআনে বারবার বিধৃত হওয়া সেই নিগুঢ় নিদর্শন, স্রষ্টার স্বরূপ, জগত-লীলার মাঝে মানুষ দেখতে পায়না। তা নাহলে জগত-প্রেমের মহীমায় আপনাকে পূর্ন করে হাতে পেত অমূল্য নিধি। পৃথিবীতে আসতো প্রেমরস-সিক্ত এক চির-দিব্য-যুগ। মানবজাতি কোন একদিন হয়তো তার দেখা পাবে, দুগ্ধ হতে পৃথক হবে ননি, আর তখন পড়ে থাকবে শুধু অসার ঘোল- ভ্রান্ত বাসনার হাড়গোড়, করোটি ও ছাই।

সংগৃহীতঃ- লাল জীপের ডায়েরী

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন