পাঞ্জু শাহ্‌ - আধ্যাত্মিক চিন্তার বিকাশ
পাঞ্জু শাহ্‌ - আধ্যাত্মিক চিন্তার বিকাশ

পাঞ্জু শাহের আত্নদর্শন পর্যালোচনাকালে তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা সম্পর্কে আভাস দেওয়া হয়েছে। দর্শনে আধ্যাত্ববাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। এজন্য দর্শন বিচার সত্ত্বেও পাঞ্জু শাহের আধ্যাত্ব- চিন্তার স্বরুপ- স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পৃথক আলোচনা আবশ্যক। এখানে সে বিষয়ে রইলো সামান্য আলোকপাতের প্রয়াস।

ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাস আধ্যাত্ববাদের মূল কথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত। চিরাচরিত ধর্মবিশ্বাসের সারকথা - “বিশ্বের অসংখ্য বৈচিত্রের পশ্চাতে একটি ব্যপক চেতন- সত্তার স্বীকৃতি”। এই সর্বব্যাপী চেতনা - সত্তারই নাম ধর্মশাস্ত্রে আল্লাহ, খোদা, ভগবান, গড ইত্যাদি। দর্শনশাস্ত্রে এই চেতন সত্ত্বারই নাম পরমসত্ত্বা, এ্যাবসিলিউট। ইতিহাসে দেখা যায়, দার্শনিকগণ আধ্যাত্ববাদের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন একত্ব অনুভূতির ভিতর। এই একত্ব অনূভূতি ধর্মশাস্ত্রে নানাভাবে বর্ণিত। তাই আধ্যাত্ববাদের প্রাচীন সমর্থকমন্ডলী শাস্ত্রবাক্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে আধ্যাত্বতত্ত্ব প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রাচীনকালে আধ্যাত্ববাদীরা অগাধ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়েই দার্শনিক বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। ফলে তাঁদের দর্শনে আগে ঈশ্বরের স্থান, পরে জগতের স্থান। ঈশ্বরের অনুভূতি থেকেই প্রাতহিক জগতের অনুভূতিতে অবতরণ। এটাই তাঁদের দার্শনিক চিন্তার বড় বৈশিষ্ট্য।

মুসলিম দার্শনিকগণ তাঁদের ধর্মচিন্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধর্ম ও দর্শনের সমঝোতা আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন, তার মূলেও এই একই সত্যের প্রতীতি। তাঁদের নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ গঠনে প্লেটোনিক, এরিস্টিটোলিয়ান এবং নিওপ্লেটোনিক চিন্তাধারা ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও দিবাদর্শন অর্থ্যাৎ জ্ঞানাতীত সত্ত্বার সাথে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্ত্বাসমূহের সম্পদের ব্যাখ্যা প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে মুতাজিলাবাদী এবং আশারীপন্থীরা তাঁদের অর্ন্তদন্দ্ব সত্ত্বেও উল্লেখিত দার্শনিকগণের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে রোজকেয়ামতে পূণ্যাত্বাদের আল্লাহর সাক্ষাৎ দর্শনের কথা স্বীকার করেছেন এবং নিজেদের দার্শনিক মতানুসারে এর সঙ্গতি ও সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করেছেন। এতে এক ‘সর্বব্যাপী একক চেতনা’ যা জড় পদার্থ নয়, বিভাজ্য সত্ত্বা নয়, সঠিকভাবে বর্ণণা-যোগ্য নয়, তারই স্বীকৃতি ব্যক্ত হয়েছে।

আধ্যাত্ববাদী দর্শনের প্রবত্তাগণ দুটি দলে বিভক্ত। একদল দার্শনিক সর্বব্যাপী একক চেতনার উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করে দৈনন্দিন জীবণের তাত্ত্বিক মূল্য প্রায় সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করেছেন। অন্য দল শ্বাশত, অবিনশ্বর, সর্বত্রুটিমুক্ত এই ‘সর্বব্যাপী একক চেতনা’ এবং ‘চলমান’, নশ্বর, ক্ষণভঙ্গুর, ত্রুটিযুক্ত অভিজ্ঞতার জগৎ’ - এদুটোকে মিলিয়ে তত্ত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। তবে উভয় দলই এই সর্বব্যাপী চেতনাকে সবচেয়ে বড় সত্তা বলে মেনে নিয়েছেন। তাঁদের মতে এই সত্ত্বার এক নাম ‘ভূমা’ অন্য নাম ‘ব্রহ্ম’। দর্শন সাহিত্যে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি বেশী প্রচলিত। এক্ষণে এই একক সর্বব্যাপী শাশ্বত পরিপূর্ণ স্বভাবসত্ত্বাকে যাঁরা বিশ্বের চরম তত্ত্ব বলে নিরুপন করেন, সেই আধ্যাত্ববাদী দার্শনিকদের মতের প্রচলিত নাম ব্রহ্মবাদ বা একত্ববাদ।একত্ববাদ আবার দুই প্রকার। যথা - নির্বিশেষ একত্ববাদ এবং সবিশেষ একত্ববাদ। নির্বিশেষ একত্ববাদ অনুসারে ব্রহ্মই পরম ও চরম সত্তা, বিশ্বজগতের সত্যিকার সত্তা নেই। আর সর্বশেষ একাত্ববাদ অনুসারেও ব্রহ্মই পরম সত্তা এবং ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অভিব্যক্তি হিসেবে বিশ্বজগতের সত্তাও আছে।

পাঞ্জু শাহের আধ্যাত্ব - চিন্তা এই নির্বিশেষ একত্ববাদ - ভিত্তিক। তাঁর মতে জগতের সত্তা মানুষের অনুভূতি সাপেক্ষ। মানুষ যত দিন ব্রহ্মকে জানে না, তত দিনই তার কাছে জগতের অনুভূতি ব্যাপক। যে মুহূর্তে সে ব্রাহ্মকে জানে, জগতের সত্তা সেই মুহূর্তেই ব্রহ্মসত্তায় হারিয়ে যায়। এমনকি মানুষ নিজেও ব্রাহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায়। পাঞ্জুর জীবণে এই ব্রহ্ম- অনুভূতি অতি ধীরে অথচ গভীরভাবে জাগ্রত হয়েছে। এ জন্য সংসার, সমাজ এবং দেশকালে অবস্থান করেও তিনি সবকিছুকে ত্যাগের দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছেন। স্ত্রী - পুত্র, আতœীয়-স্বজন, বিষয়- আশয় নিয়ে ঘড় গৃহস্থলী চালিয়েও ‘সর্বব্যাপী একক চেতনা’ অনুভব করা তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে; এ বিশ্বজগত লয়প্রপ্তির পর সেই একক ব্রাহ্ম, ধর্মীয় ভাষায় যিনি আল্লাহ, তিনি জীন - ইনসানের হিসেব নিবেন-

‘আল্লাহতালা কাজী হবে,
নেকী বদীর হিসাব নেবে।

উল্লেখ্য, এ জগৎ ও পরজগতের ধারণায় বিশ্বাসী পাঞ্জু শাহের তদীয় আধ্যাত্ববাদ নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদী অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্য থেকে উনিশ শতকের বিবেকানন্দ পর্যন্ত এ ধারার সব দার্শনিকের উত্তরসুরি। শুধু তাই নয়, খ্রীষ্টপূর্ব যুগের অর্থ্যাৎ শঙ্করের বহু আগের দার্শনিক প্লেটো, তাঁর অনুসারী প্লাটিনাস, মরমীবাদী দার্শনিক ইবনুল আরাবী, মরমীবাদী কবি-দার্শনিক মোলানা রুমী ৩ প্রমুখ চিন্তাধারার সাথে পাঞ্জু শাহের চিন্তাধারার অপূর্ব সাজুষ্য আবিস্কার করা যায়।

জগৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, সেই সাথে যাবতীয় সৃস্টি লোপ পেয়ে যাবে। পাঞ্জু শাহ আধ্যাত্ব সাধনার পথে এই ধ্বংসের প্রলয়ঙ্কারী যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় জীবন থাকতেই ‘আমিত্ব’ বিসর্জন দিতে চান। একে ধর্মীয় ভাষায় ফানা - প্রাপ্তি বলে। বস্তুত ফানা হচ্ছে জীয়ন্তে মরণ বা অহমকে লোপ করে দেওয়া। সাধনার জগতে ‘গরিবী’ হলো জগতের সব বস্তু থেকে বিমুখ ময়ে সম্পূর্ণ ‘অহোম’ বিলোপ করে সেই পূর্ণ একককে দেখা। এই সাধনার দ্বারা সাধক নিত্য জীবনের পূর্ণতা লাভ করেন। তখন তাঁর অহমিকা আচ্ছাদিত জীবণধর্ম বিলীন হয়ে যায় এবং ¯্রষ্টার করুনায় ঐশীভাবে তিনি পূর্ণ হয়ে ওঠেন। তখন তাঁর সব স্বত্ব ও সম্বন্ধের অবসান হয়। ‘ফানা’ বলতে ব্যাক্তিত্বের বিনাশ বুঝায় না। সাধনার বাধাস্বরুপ মর্ত্য-ভাবগুলো ঘুচে গিয়ে যথার্থ সত্য ও সত্ত্ব গুণে পূর্ণ হয়ে ওঠার নামই ‘ফানা’। প্রেমের ফানার পথের অবস্থাই হলো ‘হাল’ বা বাউল বৈষ্ণবদের ‘দশা’। এই জন্য চায় অর্ন্তদৃষ্টি, শ্বাশজপ এবং সর্বোপরি সেই প্রেমাস্পদের দয়া। এই অবস্থায় পৌছিয়ে পাঞ্জু বলেন-

‘ফানাফিল্লাহ হওরে মন,
দেখ বান্দা হওয়ার ভেদ কেমন।

এই ফানাকে কেউ কেউ বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘ফানা’ এবং ‘নির্বাণ’ এক নয়। তাছাড়া সূফী মরমিয়া সাধকগণ নির্বাণের পক্ষপাতীও নন। এ সম্পর্কে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। এখানে এইটুকু বলা আবশ্যক যে, ফানার পরে ‘বাকা’ সূফী সাধনার একটি বিশেষ স্তর। এই অবস্থার প্রথমে ভক্তের আতœার আকার খোদার হাতে বিলুপ্ত হয়। তখন প্রেম থাকে না, প্রেমিক থাকেন না, ভক্তের সমুদয় সত্তা এক্ষেত্রে লয় হয়ে যায়, তদরুপ ভক্তের সমুদয় সত্তা একেতে লয় হয়ে যায়। প্রেমিক -প্রেমিকা বহু বিরহের পর পরস্পর সন্দর্শনে যেমন জ্ঞানশূণ্য হয়ে উভয়ে উভয়ের প্রতি অনিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করে এবং পরস্পর সংমিলনে যেমন নিস্তব্ধ ও নিস্পন্দ হয়ে আপনাকে ভূলে যায়, তদ্রুপ ভক্তের চৈতন্যগুণও ঐ একের মধ্যে লয় পেয়ে অচেতন জড়বৎ হয়ে পড়ে। সে সময় দ্বিতীয়ত্বজ্ঞান একেবারেই থাকে না। ঐ সময় ঐশী জ্যোতিও (নূর) দৃষ্টিগোচর হয় না কিংবা জ্যোতির অধোপতন বা উর্দ্ধগমন অনুভব করা যায় না। এই অবস্থাকে ‘আহদিয়েত’ বলে। পরে প্রিয়তমের বেনিরাজী (নিরপেক্ষতা) গুণবশত এক প্রকার চৈতন্য জন্মে। তদ্বারা সৃষ্টি আপনাকে সৃষ্টি বলে বুঝতে পারে, পরস্পরে ‘তাইন’-আউল মধ্যে এসে ¯্রষ্টার দৃষ্টান্তশূন্য এক প্রকার অতি সূক্ষ জ্যোতি যা সমুদয় সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছে এবং যে সর্বব্যাপী নিরুপম জ্যোতি-সমুদ্রে সৃষ্টি নিমগ্ন রয়েছে, যার হিল্লোলে জগৎ নব নব ভাব ধারণ করেছে, সেই জ্যোতিকে পরম-পবিত্র খোদাতালার নূর বলে ভক্ত জানতে পারে। এই চৈতন্যবিশিষ্ট জ্ঞানোৎপত্তি অবস্থাকে ‘বাকাবিল্লাহ’ বলা হয়। পাঞ্জু শাহ তাঁর আধ্যাত্ববাদে এই সাধনার কথাই ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষায়:-

‘আদম রুপে ফানা হলে
নাস্তি হলো এ জনম,
কোন জাতে কোন রুপে বাক্য
হয়ে ভজি সাঁইর চরণ।।

সুতরাং পাঞ্জুর অধ্যায় সাধনা মুক্তির সারল্য নয়, প্রেম-ভক্তির সাধনা। কিন্তু শক্তি ও ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে তিনি (ব্রাহ্ম) অসীম অপার, সেখানে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু যেখানে তিনি প্রেমলীলার দায়ে আপনি এসে ধরা দিয়েছেন, সেখানেই সেই প্রেমাস্পদকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এখানে আরো একটি কথা এই যে, প্রাথমিক স্তরের সাধকদের (শরিয়তপন্থীদের) কাছে ‘ব্রাহ্ম’ বা ¯্রস্টা প্রবল প্রতাপশালী ‘প্রভূ’। আর মরমীদের (মারিফত পন্থীদের) দৃষ্টিতে ‘তিনি’ প্রেমাস্পদ, যাঁকে পেতে হয় প্রেমের পথে, অন্তরের ঐকান্তিকতার মাধ্যমে। তাই সাধারণ পন্থীদের আরাধনা ঐশ্বর্যের, কিন্তু মরমীদের আরাধনা মাধুর্যের। পাঞ্জুর আধ্যাত্ববাদে এই মাধূর্য ভজনের মনের মানুষকে উপলদ্ধি করার ঈঙ্গিত আছে। তিনি বলেন-

‘দূর কর তছবি-মালা,
মন-মালায় ধন মেলে।
মনের মানুষ দমে জপে,
বসাও হৃদ-কমলে।

আসলে এই ‘মনের মানুষ’ যথার্থ প্রেমের আধার। তাই তত্ত্ব রসিকগণ বলেন-‘প্রেমই সাধনা, দেহকর্ষণ ব্যর্ধ, কায়াযোগই সাধনীয়, বাহ্য দেবতা, মন্দির, পূজা সবই ব্যর্থ, বাহ্য আচার সম্প্রদায় সবই নিস্ফল। মূলত কায়াযোগ ও প্রাকৃত গণ বাংলাদেশের নিজস্ব আধ্যাত্ববাদ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্ববাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন - ‘রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রেমের অনুভূতি ও আধ্যাত্ব অনুভূতি বা ঈশ্বরানুভূতির ভিতর দিয়েই সার্থকতা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধ যেমন পাশ্চাত্য মানবতাবোধ নয়, ভারতীয় আদর্শের উপর তাঁর একান্ত নির্ভর, তাঁর বিশ্বপ্রেমের অনুভূতিও তাঁর ঈশ্বর ভাবনার উপর নির্ভরশীল।১ বাংলার মরমী - মনে এই বিশ্বপ্রেমেরই আবেদন চিরন্তন।

জাতকূলের বিচার এখানে নেই। পাঞ্জু শাহ গেয়েছেন-

‘কুল বলে মুই ভূলে র’লাম
ভোজের বাজি করে গেলাম।

সাধক বাংলার প্রকৃত প্রাণ-সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন, মানবীয় ভাবরস যার সারকথা। এখানে হিন্দু মুসলমান কোন ভেদ নেই। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের ভাষায় - ‘হিন্দু আধ্যাত্ব সাধনার সঙ্গে যোগ হয়েছে মুসলমান আধ্যাত্ব সাধনার। গঙ্গা- যমুনার মতো রাম-রহিমের মরমিয়া সাধনা একসঙ্গে বয়ে চলেছে।৩ পাঞ্জু শাহ এই সাধনার অনুসারী। নির্বিশেষ একত্ববাদের অব্যক্ত চিন্তাকে ভিত্তি করে মানবিকতা আর্চনাকারী মরমী কবি হিসাবে তাঁর চেতনার বিকাশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কবি বিশাল সাগরের মতো উদার চিত্ত নিয়ে জন্মেছিলেন। তাঁর আরাধ্য সর্বব্যাপী সত্তা, যিনি ‘বাঞ্জা কল্পতরু পতিত পাবন জগতগুরু।

এই জগত-গুরু উপলদ্ধি করতে হলে মানুষগুরু বা মুরশিদ আবশ্যক। ‘দর্শন’ আলোচনায় এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, দর্শনে গুরুবাদ বর্জনীয় হলেও মরমী - মনে ‘গুরুবাদ’ একমাত্র তত্ত্ব। রুমী, জামি, হাফিজ সাদী প্রমুখ মরমী কবিদের অনুসারী এবং সিরাজ, লালন, হিরুচাঁদ ইত্যাদির অনুগামী পাঞ্জুু শাহ তদীয় আধ্যতœ চিন্তার গুরুকে ব্রহ্ম পথের একমাত্র দিশারী বলে গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর সচেতন মনের বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ভাষায়ঃ-

‘গুরু - বস্তু না জেনে
এবার সাধের জনম যায় যে যমের ভূবণে।

পাঞ্জুু শাহের আধ্যাত্ববাদ কোন অবাস্তব বা অলীক কল্পনাপ্রসূত নয়। ¯্রষ্টাকে উপলদ্ধির জন্য পয়গম্বর দরকার, আর পয়গম্বরকে জানার জন্য গুরুর প্রয়োজন। গুরুপ্রাপ্ত শিক্ষার গুনেই ‘দেহতত্ত্ব’ ‘মানুষতত্ত্ব’ ‘মনের মানুষ - তত্ত্ব’ ইত্যাদি অভিনবভাবে জানা যায়।

পাঞ্জু শাহ্‌ এর সমাধি স্থল

একটি সামগ্রিক চিন্তাচেতনা পাঞ্জুু-মানসে তত্ত্বকথা ও তত্ত্বসঙ্গীত সৃষ্টি করেছে। শেষে কবির আধ্যাত্ববাণী কবিতা ও গান আকারে বিকাশ লাভেরও সুযোগ পেয়েছে। আধ্যাত্বরুপ শিল্পরুপ ধারণ করে সাহিত্য রসে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে, পাঞ্জুু সাহিত্য তার যথার্থ প্রমাণ। ‘ভাষার সরলতায়, ভাবের গম্ভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না, তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনী ভক্তি রস মিশেছে।’ পাঞ্জুু শাহের আধ্যাত্ববাদ, ধর্ম, দর্শন ও অধিবিদ্যার সম্বন্বয়, যার মধ্য দিয়ে একটি বিশুদ্ধ তত্ত্বচিন্তা বিকাশ লাভ করেছে।

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ