বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

আবদুল জব্বার এবং গীতিকার আমিরুল ইসলাম
আবদুল জব্বার এবং গীতিকার আমিরুল ইসলাম

বাংলা গানের কিংবদন্তি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক আব্দুল জব্বারের মৃত্যুতে সংগীত জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার একমাত্র অ্যালবামের গীতিকার আমিরুল ইসলাম। আমিরুল ইসলাম বর্তমান সময়ের একজন সৃষ্টিশীল গীতিকার। ১৯৭৯ সালের ১৫ই নভেম্বর লালনের চারণভূমি কুষ্টিয়ায়। পদ্মা গড়াই বিধৌত কুষ্টিয়ার শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা আমিরুল ইসলাম ছেলেবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি ভীষণ টান ও ভালবাসা অনুভব করতেন।

সেই ভালবাসা থেকে একটু আধটু লেখালেখিও করতেন। তখন কে জানত, একদিন আমিরুল ইসলাম বাংলা গানের কিংবদন্তি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক আব্দুল জব্বারের একমাত্র মৌলিক গানের অ্যালবামের গীতিকার হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।

যার মাতাল গায়কীর মাধুর্যে মন্ত্রমুগ্ধ হতো অগণিত দর্শক-শ্রোতা, যার ভরাট কণ্ঠের জাদুতে বাংলা গানের ইতিহাসে সূচনা হয়েছিল সোনালি স্বর্ণালী যুগের, তিনি হলেন শিল্পী আবদুল জব্বার। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ২০০৮ সালে। আমার ‘এখানে আমার পদ্মা মেঘনা’ গানটি তার কণ্ঠে রেকর্ডের পর তিনি একটি অ্যালবাম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি একে একে অ্যালবামের বাকি গানগুলো রচনা করলাম। তার শিল্পী জীবন নিয়ে একটি গান লিখলাম। গানটির কথা- ‘আমাকে তোমাদের ভালো না লাগলেও আমার এই গান ভালো লাগবে।’ গানটি দেখে জব্বার ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘শুধু আমি নই। প্রতিটি শিল্পীর মনের কথা লিখেছ।’ চ্যানেল টোয়েনটিফোরে প্রচারিত ‘আমার যত গান’ অনুষ্ঠানে ও তিনি এমনটি জানিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে গানটি গাওয়ার পরে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পরে আমাকে যখন কাঁধে করে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হবে, আমার ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের সঙ্গে এই গানটি ও যেন বাজানো হয়।’ অবশ্য তার সেই ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল।

সুরকার গোলাম সারোয়ার ভাই গানগুলোর সুর করলেন। ২০০৯ সালে অ্যালবামের কাজ শেষ হলো। অ্যালবামের নাম ঠিক করা হলো ‘মা আমার মসজিদ, মা আমার মন্দির।’ এই শিরোনামে ডেইলি স্টার, দৈনিক মানবকণ্ঠ ইত্যাদি কিছু জাতীয় দৈনিক অ্যালবামের সংবাদ প্রকাশ করল। জব্বার ভাই বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন চ্যানেলে অ্যালবামের গানগুলো গাইতে থাকলেও অ্যালবাম রিলিজের কোনো আগ্রহ দেখালেন না। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। আমি ও প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। তার শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছিল না। একদিন তার ভূতের গলির বাসায় গিয়ে অ্যালবাম প্রকাশের ব্যাপারে কথা বললাম। তিনি রাজি হলেন। অ্যালবামের নাম পরিবর্তন করা হলো। তার ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের সঙ্গে মিল রেখে অ্যালবামের নতুন নামকরণ করা হল ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া।’ অবশেষে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ শিরোনামে অ্যালবামটি অনলাইনে মুক্তি পেল। সৃষ্টি হলো আবদুল জব্বারের একমাত্র মৌলিক গানের অ্যালবাম। তার এই সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম সারাজীবনের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর ওপর গাওয়া জব্বার ভাইয়ের শেষটি গানটি ও (বাংলাদেশের হৃদয় তুমি) ছিল আমার লেখা। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরেকটি গান লিখতে বলেছিলেনঃ-

‘বঙ্গবন্ধু দেখেছি তোমায়,
দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ
হায়েনাদের তাড়িয়ে দিয়ে করেছ মাটি শুদ্ধ’

-এমন কথার একটি গান লিখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর গানটি রেকর্ড করা হলনা। অ্যালবামের কাজ করতে গিয়ে আবদুল জব্বারকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আবদুল জব্বারের অস্তিত্বজুড়ে ছিল নিখাদ নির্ভেজাল দেশপ্রেম। আর এই প্রবল প্রমত্ত দেশপ্রেমের টানেই তিনি মৃত্যুকে ভ্রুকুটি করে একাত্তরের রণাঙ্গনে দীপ্তকণ্ঠে গর্জে উঠেছিলেন, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ বলে। নতুনদের জন্য তিনি এক বড় প্রেরণা, বিরল আদর্শ। আমাকে তিনি প্রায় প্রায় বলতেন, ‘আমিরুল, গান লেখা ছেড়ো না। কবি নজরুল খেয়ে না খেয়ে গান লিখে গেছেন।’

বর্তমান দশকে সম্ভবত আমিই একমাত্র গীতিকার আবদুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরিচয়ের পর থেকে মৃত্যু অবধি আমি তার পাশে ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার অজস্র স্মৃতি। কখনো স্টুডিওতে, কখনো বিটিভিতে, কখনো বা তার নিজ গৃহে। সে সব স্মৃতির মিছিলে অশ্রুসজল চোখে আমি কেবলই হাতড়ে বেড়াই তাকে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে জব্বার ভাই চিরবিদায় নিয়েছেন সত্য। জাত শিল্পীর কখনো মৃত্যু হয়না। তিনি এই বাংলায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আজো বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় তার চিরচেনা কণ্ঠঃ-

‘হাজার বছর পরে
আবার এসেছি ফিরে
বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’।

লাখো কোটি যোজন দূরে থেকেও নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে বাংলা গানের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে তিনি জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন যুগ যুগ ধরে। এখনো আমি কান পেতে শুনতে পাই তিনি যেন আমাকে বলছেন, ‘আমিরুল, আমার জন্য গান লেখো।’ আমি আর কোনোদিন তার জন্য গান লিখব না। ব্যথায় বিষাদে অশ্রুতে ভিজে আমার কলম বার বার থেমে যেতে চায়।

স্মৃতিচারণ আমিরুল ইসলাম - গীতিকার ও শিক্ষক

কুষ্টিয়াশহর.কম কণ্ঠসৈনিক আবদুল জব্বারের আত্মার মাগফিরাত এবং গীতিকার আমিরুল ইসলাম আরো সুন্দর সুন্দর গান আমাদের উপহার দিবেন সেই কামনা করছে।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন