আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনাবলি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনাবলি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্ম: ৭ই মে, ১৮৬১ - মৃত: ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (জন্ম: ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - মৃত: ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার ও দার্শনিক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তিনি তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তার সারা জীবনের কর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তিনি বিশ্বকবি, কবিগুরু ও গুরুদেব নামে পরিচিত। বলা যায় তাঁর হাতে বাঙ্গালীর ভাষা ও সাহিত্য,শিল্পকলা ও শিল্প চেতনা নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে।

তিনি বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার "সোনার বাংলা", ভারতের জাতীয় সঙ্গীত "জন গণ মন" এবং শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত "আপা শ্রীলংকা, নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরণী"র মূল সংস্করণের লেখক ও সুরকারও রবীন্দ্রনাথ।

কলকাতার পিরালী ব্রাহ্মণ সমাজের অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। ১৮৭৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম ছোট গল্প এবং নাটক লিখেন। এর আগেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত কাব্যের জন্ম দিয়েছিলেন যা ভানুসিংহ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। পারিবারিক শিক্ষা, শিলাইদহের জীবন এবং প্রচুর ভ্রমণ তাকে প্রথাবিরুদ্ধ এবং প্রয়োগবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। তিনি ব্রিটিশ রাজের প্রবল বিরোধিতা করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তার পুরো পরিবারের পতন এবং বাংলার বিভক্তিরেখার নিদর্শন তাকে দেখতে হয়েছিল। এদিক থেকে তার জীবনকে দুঃখী বলতেই হয়। কিন্তু তার কবিতা, অন্যান্য সাহিত্য আর বিশ্বভারতী প্রতিণ্ঠা তার জীবনকে যে মহিমা দান করেছে তা আজীবন হয়তোবা টিকে থাকবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদা দেবীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ১৩তম। জন্মের সময় তার ডাক নাম রাখা হয় রবি। ১১ বছর বয়সে তার উপনয়ন সম্পন্ন হওয়ার পর ১৮৭৩ সনের ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখে ঠাকুর তার বাবার সাথে কলকাতা ত্যাগ করেন ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে যান তারা। এর মধ্যে ছিল শান্তিনিকেতনে দেবেন্দ্রনাথের নিজস্ব সম্পত্তি, অমৃতসর এবং হিমালয় অধ্যুষিত পাহাড়ি স্টেশন ডালহৌসি। সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনী পড়েন, অধ্যয়ন করেন ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আধুনিক বিজ্ঞান এবং সংস্কৃত। এছাড়াও তিনি কালিদাসের ধ্রুপদি কাব্যের সাথে পরিচিত হন ও এর বিভিন্ন পর্যালোচনা করেন।

১৮৭৭ সনে তিনি প্রথম জনসম্মুখে পরিচিতি লাভ করেন। কারণ এ সময়েই তার কিছু সাহিত্যকর্ম প্রথম প্রকাশিত হয়। এর মধ্য ছিল মৈথিলি ভাষার সাংস্কৃতিক আদলে রচিত কিছু সুদীর্ঘ কবিতা। এ ধরণের কবিতা প্রথম লিখেছিলেন কবি বিদ্যাপতি। এই কবিতাগুলো সম্বন্ধে কৌতুক করে তিনি একবার বলেছিলেন, এগুলো হচ্ছে ভানুসিংহের (সপ্তদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব কবি যার নাম অনেক পরে পরিচিতি লাভ করেছে) হারিয়ে যাওয়া কাব্য সংগ্রহ। একই বছর তিনি লিখেন ভিকারিনী যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোট গল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। ১৮৮২ সনে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সন্ধ্যা সংগীত প্রকাশিত হয় যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ নামক বিখ্যাত কবিতাটি।

১৮৭৮ সনে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। তাকে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পড়াশোনা করেন। কিন্তু ১৮৮০ সনে কোন ডিগ্রি লাভ ছাড়াই তিনি বঙ্গে ফিরে আসেন।

১৮৮৩ সনে তিনি মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন বিয়ের সময় যাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। জন্মের সময় মৃণালিনীর ডাক নাম ছিল ভবতারিণী (১৮৭৩ - ১৯০২)। তাঁদের পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়েছিল যাদের মধ্যে ২ জন শিশুকালেই মারা যায়।

১৮৯০ সাল থেকে ঠাকুর শিলাইদহে তার বাবার সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা শিলাইদহে তাঁর সাথে যোগ দেয়। সেই সময় জমিদার বাবু নামে পরিচিত রবি ঠাকুর, পরিবারের আরামদায়ক জীবন ত্যাগ করে পদ্মার কোল জুড়ে বিপুল পরিমাণ এলাকা ভ্রমণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল তার ভূমিতে বসবাসকারী গ্রাম্য অধিবাসীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং তাদের সাথে কথা বলে আশীর্বাদ করা। বিভিন্ন স্থানে তার সম্মানে গ্রামের লোকেরা উৎসবের আয়োজন করতো। এই বছরগুলোতে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো গল্প রচনা করেন। তাঁর তিন খণ্ডে রচিত বিখ্যাত গল্প সংকলন গল্পগুচ্ছের (যাতে মোট ৮৪টি ছোট গল্প রয়েছে) প্রায় অর্ধেক গল্প এখানে থাকা অবস্থাতেই রচনা করেছেন। এই গল্পগুলোতে ব্যঙ্গ এবং আবেগের সমন্বয়ে গ্রাম বাংলার সঠিক চিত্র নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।

১৯০১ সনে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে শিলাইদহ ছেড়ে যান। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন মূলত একটি আশ্রম স্থাপনের লক্ষ্যে। এই আশ্রমে তিনি গড়ে তোলেন একটি মার্বেল পাথরের মেঝেবিশিষ্ট মন্দির, একটি পরীক্ষামূলক বিদ্যালয়, বাগান এবং গ্রন্থাগার। এখানেই রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মৃত্যু ঘটে। ১৯০৫ সনের জানুয়ারি ১৯ তারিখে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি মাসিক ভাতা ও বেতন পেতে শুরু করেন। এছাড়াও তিনি ত্রিপুরার মহারাজা, পারিবারিক গহনার ব্যবসা, পুরিতে অবস্থিত বাংলো এবং নিজ সাহিত্যকর্মের সম্মানী; এই উৎসগুলো থেকে অর্থ পেতেন। প্রকাশনার সম্মানী হিসেবে তিনি প্রায় ২,০০০ টাকা পেতেন। এসময় তার সাহিত্যকর্ম দেশে-বিদেশে বিপুল পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এরপর ১৯০১ সনে নৈবেদ্য এবং ১৯০৬ সনে প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ খেয়া। একই সাথে তার কবিতাগুলোকে free verse-এ রূপান্তরের কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯১৩ সনের নভেম্বর ১৪ তারিখে তিনি জানতে পারেন, যে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তারই লেখা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের সফল ইংরেজি অনুবাদ যার ফলে পাশ্চাত্যের পাঠকেরাও তার সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভে সক্ষম হয়েছে।

১৯২১ সালে ঠাকুর কৃষি অর্থনীতিবিদ লিওনার্ড কে এল্‌মহার্স্টের সাথে মিলে শান্তিনিকেতনের নিকটে অবস্থিত সুরুল নামক গ্রামে পল্লী পুনর্নিমাণ সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে এর নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন শ্রীনিকেতন। এই শ্রীনিকেতনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্বান ও পণ্ডিতদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এখানে গ্রামের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত করেন এবং তাদের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস নেন।

১৯৩০-এর দশকে তিনি ভারতবর্ষের অস্বাভাবিক বর্ণবিভেদ এবং বর্ণে বর্ণে ধরা-ছোঁয়ার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মতামত প্রচার শুরু করেন। তিনি এই বর্ণবিভেদের বিপক্ষে বক্তৃতা, কবিতা রচনা, বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে নাটক রচনা এবং কেরালার একটি মন্দিরে এই প্রথা ত্যাগের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে তার আন্দোলন পরিচালনা করেন। মূলত দলিতদের সাধারণ সমাজে অবাধ প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য।

জীবনের শেষ দশকের পুরোটা রবীন্দ্রনাথ জনসমক্ষে ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এসময় ছিল তুঙ্গে। ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের বিহার রাজ্যে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন যে, এটি দলিতদেরকে বশীভূত করার জন্য ঈশ্বরের একটি প্রতিশোধ। রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যের জন্য গান্ধীকে জনসমক্ষে তিরস্কার করেন। এছাড়া বঙ্গের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি এবং কলকাতায় দরিদ্রতার প্রাদুর্ভাবের কারণে তিনি বিশেষ দুঃখ প্রকাশ করেন। ১০০ লাইনের একটি মিত্রাক্ষর বর্জিত কবিতায় তিরি তার এই বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। দ্বিমুখী চিন্তাধারাকে ঝলসে দেয়ার এই কৌশল পরবর্তিতে সত্যজিত রায় পরিচালিত অপুর সংসার নামক চলচ্চিত্রে অনুসৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ এসময় তার লেখার সংকলন ১৫টি খণ্ডে প্রকাশ করেন। এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ছিল পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫) এবং পাত্রপুট (১৯৩৬)। তিনি prose-songs এবং নৃত্যনাট্য রচনার মাধ্যমে তার বিভিন্ন পরীক্ণ চালিয়ে যেতে থাকেন যার মধ্যে রয়েছে "'চিত্রঙ্গদা" (১৯১৪), "শ্যামা" (১৯৩৯) এবং "চণ্ডালিকা" (১৯৩৮)। এসময়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে "দুই বোন" (১৯৩৩), "মালঞ্চ" (১৯৩৪) এবং "চার অধ্যায়" (১৯৩৪)।

জীবনের শেষ বছরগুলোতে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি বিশেষ আগ্রহের পরিচয় দেন যার প্রমাণ তার রচিত "বিশ্ব পরিচয়" (১৯৩৭) নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন। তিনি জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন, তার সে সময়কার কবিতা এবং সাহিত্যকর্মে বিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতি তার বোধগম্যতা আমাদেরকে সে প্রমাণই দেয়। এই সাহিত্যকর্মে উচ্চমানের প্রকৃতিবাদ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন গল্পে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করেন যার মধ্যে রয়েছে, "সে" (১৯৩৭), "তিন সঙ্গী" (১৯৪০) এবং "গল্পসল্প" (১৯৪১)।

জীবনের শেষ চার বছর রবীন্দ্রনাথের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ছিল এবং তার এই দুরারোগ্য অসুস্থতা মোট দুই বছর বজায় ছিল। ১৯৩৭ সালের শেষ দিকে তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন এবং এরপর দীর্ঘ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় কোমায় ছিলেন। তিন বছর পর ১৯৪০ সালে আরেকবার ভাল রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন যা থেকে আর আরোগ্য লাভ করতে পারেন নি।

এসময় রচিত কবিতাগুলো তার জীবনের অন্যতম প্রধান রচনা হিসেবে খ্যাত কারণ এর মধ্যে মৃত্যু দুয়ারে তার পদচারণার আভাস প্রস্ফুটিত হয়েছিল।

দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখে (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ির উপর তলার একটি কক্ষে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। এই ঘরেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যুবার্ষিকী এখনও বিশ্বের সকল প্রান্তের বাংলাভাষীরা বিশেষ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকে।

ঠাকুরের ভ্রমণের নেশা ছিল প্রখর। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সনের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশী দেশ ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো সফরেরই উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বাইরে এবং অবাঙালি পাঠক এবং শ্রোতাদেরকে তার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া এবং তার রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করা। যেমন ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় তিনি তার এক তাক বইয় নিয়ে যান এবং এই বইগুলো বিভিন্ন মিশনারি ব্যক্তিত্ব, গ্রান্ধী প্রতিজি চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্‌স, এজরা পাউন্ড রবার্ট ব্রিজেস, আর্নস্ট রাইস প্রমুথ অনেককেই মুগ্ধ করেছিল। এমনকি ইয়েট্‌স গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন এবং অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে তার সাথে যোগ দেন। ১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর ঠাকুর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ভ্রমণে যান। যুক্তরাজ্যে তিনি অ্যান্ড্রুজের চাকুরিজীবী বন্ধুদের সাথে বাটারটন এবং স্ট্যাফোর্ডশায়ারে অবস্থান করেছিলেন। ১৯১৬ সালের মে ৩ থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা করেন। এইসব বক্তৃতায় তিনি জাতীয়তাবাদ- বিশেষত জাপানী এবং মার্কিন জাতীয়তাবাদের নিন্দা করেন। তিনি "ভারতে জাতীয়তাবাদ" নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি বিদ্রুপ এবং এর প্রশংসা উভয়টিই ছিল। বিশ্বজনীন শান্তিবাদে বিশ্বাসীরা অবশ্য এর প্রশংসাই করে থাকেন যেমন করেছেন রোমাঁ রোঁলা। সেখান থেকে ভারতে ফিরে আসার পরপরই ৬৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পেরুভিয়ান সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যান এবং একই সাথে মেক্সিকো যাওয়ার সুযোগটিও গ্রহণ করেন। তার সফরের সম্মানে উভয় দেশের সরকারই শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী শিক্ষাঙ্গণের জন্য ১০০,০০০ মার্কিন ডলার অনুদান দেয়। ১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়র্‌স-এ যান। কিন্তু সেখানে যাবার এক সপ্তাহের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-তে অবস্থিত Villa Miralrío-তে নিয়ে যাওয়া হয়। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একই বছরের ৩০ মে তিনি ইতালির নেপ্‌লসে পৌঁছেন এবং পরদিন ইতালির ফ্যাসিবাদী একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছিল। কিন্তু ১৯২৬ সালের ২০ জুলাই রবীন্দ্রনাথ প্রথম মুসোলিনির বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং এর ফলে তাদের মধ্যকার সে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ১৯২৭ সালের ১৪ জুলাই ঠাকুর অন্য দুইজন সঙ্গী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি স্থানে চার মাসের সফরে যান। এই স্থানগুলোর মধ্যে ছিল বালি, জাভা দ্বীপ, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম এবং সিঙ্গাপুর। তার সে সময়কার ভ্রমণকাহিনী যাত্রী নামক রচনায় স্থান পেয়েছে। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে তিনি ইউরোপ এবং আমেরিকায় বছরব্যাপী সফরের উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন। সফর শেষে যুক্তরাজ্যে ফিরে যাওয়ার পর লন্ডন এবং প্যারিসে তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। এসময় তিনি বার্মিংহামে ধর্মীয় ভ্রাতৃসংঘের আশ্রয়ে অবস্থান করছিলেন। এখানে বসে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার বিখ্যাত হিবার্ট ভাষণ প্রস্তুত করেন। তার এই ভাষণের বিষয় ছিল আমাদের ঈশ্বরের মানবতাবোধ এবং মানুষ ও পরমাত্মার স্বর্গীয় রূপ। তিনি লন্ডনের বার্ষিক কোয়েকার সম্মেলনেও বক্তৃতা করেছিলেন। সেখানে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের সম্পর্ক যে বিষয়কে কেন্দ্র করে তিনি পরবর্তী দুই বছর অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছেন। একইসাথে তিনি "dark chasm of aloofness" নিয়েও কথা বলেছিলেন। তার পরবর্তী সফর ছিল ডার্টিংটন হলে অবস্থিত আগা খান ৩-এ। ডার্টিংটন হলেই তিনি অবস্থান করেছিলেন। এরপর ভ্রমণ করেন ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানি। ১৯৩০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়টা এভাবেই কেটে যায়। এরপর যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। সর্বশেষে ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের শাহ রেজা শাহ পাহলভি তাকে সরকারীভাবে আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ইরানী কবি হাফিজের অতিন্দ্রীয় ফরাসি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। শাহের আমন্ত্রণে তিনি ইরানে যান। এই ভ্রমণগুলোর মাধ্যমে ঠাকুর তৎকালীন সময়ের আলোচিত এবং বিখ্যাত অনেকের সাথে পরিচিত হন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেনরি বার্গসন, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস এবং রোঁমা রোঁলা। বিদেশে তার একেবারে শেষ সফরগুলোর মধ্যে ছিল ১৯৩২ সালে ইরান, ইরাক সফর; ১৯৩৩ সালে সেইলন ভ্রমণ। তার সকল ভ্রমণ সামগ্রিকভাবে তাকে মানুষে মানুষে বিভাজন এবং জাতীয়তাবাদের স্বরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম করে তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্য হচ্ছে তার কবিতা এবং গান। অবশ্য উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ভ্রমণ কাহিনী এবং নাটক রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কবিতা ও গান বাদ দিলে তার সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা হচ্ছে ছোটগল্প। তাকে বাংলা ভাষায় ছোটগল্প রচনাধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সাহিত্যকর্মের ছান্দসিক, আশাবাদী এবং গীতিধর্মী রূপ সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। সাধারণ বাঙালিদের জীবনই ছিল তার প্রধান উপজীব্য। রবীন্দ্রনাথ আটটি উপন্যাস ও চারটি উপন্যাসিকা লিখেছেন যার মধ্যে রয়েছ চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা, চার অধ্যায় ও নৌকাডুবি। অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের গানে প্রাচীন আইরিশ এবং স্কটিশ সুর ও ছন্দের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় , "পুরোনো সেই দিনের কথা" গানটির মূল সুর নেয়া হয়েছে স্কটিশ লোকগীতি "অল্ড ল্যাং সাইন" হতে। এছাড়া তার অনেক গানেই স্থানীয় বাউল গান, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের উচ্চাঙ সঙ্গীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।