বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে
লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে

ধর্মীয় গোড়ামি, কুসংস্কার আর সামাজিক অন্যায়ের নিন্দা জানতে গিয়ে কবির এবং লালন উভয়ের তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার করেছেন। হিন্দু কুসংস্কারের নিন্দা জানাতে গিয়ে কবির বলেছেনঃ-

পাহান পুঁজে হরি মিলে তো ম্যায় পুঁজু পাহান
উসসে তো চাক্তি ভালি, পিস খায়ে সানসার
(পাথর পুঁজে ঈশ্বর মিললে আমি পাহাড় পুঁজতে রাজি
তার চেয়েও জাঁতা ভালো, সে তো জোগায় সংসারের অন্ন)



মুসলিম আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে কবির বলেছেনঃ

কঙ্কর পাথর জোরাকে, মসজিদ লায়ি বানায়ি
তা চাড়হি মুল্লা ব্যঙ্গ দে, কেয়া বেহরা হুয়া খুদায়ি
(পাথর-সুত্তকি দিয়ে তাঁরা বানিয়েছে মসজিদ
তার চুড়ায় উঠে চিৎকার করছে মোল্লা। সৃষ্টিকর্তা কি বধির?)



লালনও মুসলমান ও হিন্দু আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে একই সঙ্গে আক্রমণ চালিয়েছন এই বলেঃ-

সুন্নাৎ দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কী হয় বিধান
বামুন চিনে পৈতে প্রমাণ
বামনি চিনে কী ধরে।



লালন আর কবিরের কবিতাই অনেক তাৎপর্যপূর্ণ তফাৎ আছে। কবিরের দুলাইনের কবিতাগুলো সংযত, সংহৃত, সযত্নে নির্মিত আর সে কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়াশীল। বিপরীতে লালন তাঁর গান লিখে রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন না বলে তিনি পথ চলতে চলতে আপন মনে গান বেঁধেছেন। সে কারণে তাঁর গান পুনরাবৃত্তিমূলক। লালন গাইতেন শ্রোতাদের সামনে। সে কারণে তাঁর গানের প্রকৃতি অনেকটা কথোপথনমূলক এবং সময়বিশেষে খুবই নাটকীয়। কখোনো তিনি কথা বলেছেন নিজেই নিজেকে সম্মোধন করে। তাঁর অনেক গান শুরু হয়েছে কোনো একটা প্রশ্ন দিয়েঃ-

পাবে কী তাঁর দেখা



অথবা,

এই মানবজনম আর কী হবে।



লালনের গানের আরেকটি উপাদান ‘ভক্তি’ যা কবিরের মতো মরমী কবির মঞ্চে পাওয়া যায় না। তুলসীদাস কিংবা সুরদাসের মতো ভারতের অনেক কবির মতো লালনও তাঁর পাপকর্মের জন্য আনুতাপ করেছেন, ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে ক্ষমাভিক্ষা করেছেন। যেমন তাঁর গানে আছেঃ-

অকর্মের ফল ভোগে লালন
চিরদিন কুপথে গমন
ক্ষমা করো হে অপরাধ আমার, এই ভবকারাগারে ।



অন্য অনেক প্রসিদ্ধ ভক্তিবাদী কবি ও দার্শনিক মতো লালনও ভক্তিমার্গের অসারতা অনুভব করেছিলেন। সে কারণে তিনি ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

লালনের জীবনেতিহাস এ কথাই প্রমাণ করে যে, খুব সাধারণ ও অস্পষ্ট জন্মসূত্র হওয়া সত্ত্বেও সাহস আর বিশ্বাসের শক্তিতে একটি মানুষ জরাজীর্ণ, অনৈতিক, শোষণমূলক সামাজিক রাজনীতিকে অস্বীকার করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় এ ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুধু তাঁর প্রজন্মের মধ্যেই ধ্বনিত হয় না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও বাহিত হতে থাকে। ভারতবর্ষের মাটিতে ঘুরেফিরেই এমন সব মানুষের অগমন ঘটেছে। তাঁদের চারপাশে জমে গেছে অনুসারীদের ভিড়, তাঁরা জীবদ্দশায় দেবতুল্য শ্রদ্ধার অধিকারী হয়েছেন। আমাদের প্রজন্মে তেমনই একজন ব্যক্তি হচ্ছে গান্ধীজী আর ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় সেই ব্যক্তিটি ছিলেন ফকির লালন শাহ্‌।

লালনের কবিতা আর গান এক অমূল্য উত্তরাধিকার। এই শুধু ভারতের সম্পদ নয়, উপমহাদেশের তিনটি দেশেরই অভিন্ন ঐশ্বর্য। লালনগীতিতে যে বানী প্রচার করা হয়েছে আজকের দিনে তাঁর প্রাসঙ্গিতা বিপুল। আর যখন সাম্প্রদায়িকতা আর বর্ণবাদের পুনরুথান ভারতের ঐক্য আর গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমিতে চিড় ধরিয়েছে তখন লালনের খাঁটি মানবপ্রেম, আর ভ্রাতৃত্বের বানী যে কাউকে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

অনুবাদঃ শিবব্রত বর্মণ।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.