লালনের গানের পাঠোদ্ধার
লালনের গানের পাঠোদ্ধার

লালনের গানের যেসব সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর ওপর আমি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে পারিনি। কারণ, সেগুলো দুর্বলভাবে সম্পাদিত ও ভুলে পরিপূর্ণ। বহু ক্ষেত্রে পাঠ কোনো অর্থ বহন করে না এবং এসব পাঠ স্পষ্টত বিকৃত। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমি দেখেছি যে ভুলভ্রান্তি সহজে লক্ষযোগ্য নয়। আমি বুঝতেও পেরেছি যে সরাসরি পরিবেশনা থেকে আমি যেসব গান টেপ রেকর্ডারে তুলে নিয়েছি, তার ওপরও পুরোপুরিভাবে নির্ভর করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে শিল্পীরাও আমাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন। কারণ, গান গাওয়ার সময় যখন তাঁরা গানের কোনো অংশ ভুলে যান, তখন যেভাবে পারেন সে ফাঁকটুকু পূরণ করে নেন।

এসব কারণে আমার মনে হয়, লালনের গানের প্রামাণিক ও নির্ভরযোগ্য সংস্করণ যত দিন না প্রকাশিত হয়, তত দিন সঠিক পাঠ নির্ধারণের জন্য উত্তম পন্থা হলো লালনগীতির মূল উৎসভূমি যশোর ও কুষ্টিয়ার লালনপন্থী প্রবীণ ফকিরদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যত দূর সম্ভব প্রতিটি গানের নিভুর্ল পাঠ নির্ণয় করা। এই পদ্ধতি সব সময় অনুসরণ করা সহজ নয়। কারণ, বাউল-ফকিররা সাধারণত নিজের আস্তানায় একনাগাড়ে বেশি দিন থাকেন না। তাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়ান। সে জন্য এক জায়গায় ধরে বসিয়ে তাঁদের সঙ্গে ধীরে-সুস্থে আলাপ-আলোচনা করে গবেষণার উপাদান বের করে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমার ভাগ্যই বলতে হবে যে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে লালনগীতির অন্যতম প্রধান শিল্পী ও তত্ত্বজ্ঞ খোদা বক্স বিশ্বাসকে আমি ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীতে তিন মাসের জন্য পাই। তখন তিনি ওই একাডেমীতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। ওই তিন মাসে প্রায় প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে আমি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। দুঃখের বিষয় এই যে লালনগীতির এই বিশিষ্ট সাধক এখন আর বেঁচে নেই। খোদা বক্স তাঁর গুরু শুকচাঁদ শাহের সঙ্গে ২০ বছর কাটিয়েছেন। শুকচাঁদ শাহের গুরু ছিলেন বৃহত্তর যশোর জেলার হরিয়ারঘাটের অন্য এক খোদা বক্স শাহ। সেই খোদা বক্স শাহের গুরু ছিলেন মনিরুদ্দিন শাহ।

মনিরুদ্দিন শাহ ছিলেন লালনের নিজের হাতে দীক্ষিত শিষ্য। খোদা বক্সের হিসাব অনুযায়ী, তিনি লালনের ৫০০ গান জানতেন এবং তাঁর স্মৃতিভান্ডারে ৭৬ জন লোককবির ১ হাজার ৭০০ গান ছিল। খোদা বক্স গানের প্রকাশিত পাঠ এবং তাঁর গুরুর কাছে শেখা পাঠের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গানের পাঠের এই পার্থক্য অর্থের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খোদা বক্সের পাঠ রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত খাতার পাঠের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে গানগুলো সঠিকভাবে চালু রয়েছে। বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত খাতায় যেসব গান নেই, সেসব গানের পাঠ অন্তত আরেকজন ফকিরের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে বর্তমানে যশোর-নিবাসী প্রবীণ ফকির আবদুল করিম শাহের সাহায্য পেয়েছি। খোদা বক্সের গাওয়া গানের পাঠ বিবেচনা করার সময় আমি এমন পদ্ধতি অনুসরণ করেছি, যাতে বিকল্প পাঠ উপেক্ষিত না হয়। উপরন্তু খোদা বক্সের পাঠ গ্রহণের আগে দেখতে হয়েছে তা বাউল ধর্ম ও দর্শনের নিরিখে যুক্তিযুক্ত কি না।

লালনের গানের প্রকাশিত পাঠের সঙ্গে খোদা বক্সের মৌখিক পাঠ তুলনা করে দুটি উদাহরণ পেশ করছি। ‘কুলের বউ হয়ে আর কত দিন থাকবি ঘরে’ মুখসহ লালনের এই গানের একটি পঙ্ক্তি লালন গীতিকায় (মতিলাল দাস ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র, ১৯৫৮: ১৪ নং গান) এভাবে দেওয়া আছে: ‘দিস নে আর আড়াই কড়ি’। এই গানের প্রসঙ্গে আমি ‘আড়াই কড়ি’র তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। লালনের গানের বিভিন্ন সংকলন দেখে আমার সংশয় শুধু বাড়ে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথের পূর্বকথিত গানের খাতায় নেই। ‘আড়াই কড়ি’র বদলে লালন শাহ ও লালন গীতিকায় (মুহম্মদ আবু তালিব, ১৩৭৫: দ্বিতীয় খণ্ড, ২৫৫ নং গান) ‘আচার কড়ি’ দেওয়া আছে। শাব্দিক অর্থ উদ্ধার করা গেলেও তাত্ত্বিক অর্থ আবিষ্কার করা যায় না। কী আচার-অনুষ্ঠানের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। ভাব সঙ্গীত-এর (খোন্দকার রফিউদ্দিন, ১৩৭৪: ২০৪ নং গান) পাঠে আছে ‘আটির কড়ি’।

এই পাঠটি প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে মনে হয়। খোদা বক্সের পাঠ অনুযায়ী ‘কড়ি’র আগের শব্দটি ‘আঁচির’ হওয়া উচিত। এই পাঠ আমি প্রথম খোন্দকার রিয়াজুল হকের কাছে শুনেছি। উনি এই গানটির পাঠ খোদা বক্সের কাছে পেয়েছেন এবং আমি পরে এ ব্যাপারে খোদা বক্সের অনুমোদন পেয়েছি। ‘আঁচি’ মানে ‘জননাশৌচ’ (জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, ১৩৪, প্রথম ভাগ) এবং ‘আঁচির কড়ি’ মানে ‘যে টাকা দাইকে দেওয়া হয়’। এই পাঠ বাউল ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বহন করে। বাউলরা তাঁদের যৌনসাধনায় বীর্য ধারণ করার পদ্ধতি অনুসরণ করেন। যাঁরা এই সাধনায় সফল হন, তাঁদের সন্তানসন্ততি হয় না। তাই দাইয়ের টাকা আর দিতে হয় না। সম্পূর্ণ গানটির অর্থবিচারে ‘আঁচি’ শব্দটি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ:

কুলের বউ হয়ে মন আর কত
দিন থাকবি ঘরে।
ঘোমটা খুলে চল না রে
যাই সাধ-বাজারে
কুলের ভয়ে কাজ হারাবি,
কুল কি নিবি সঙ্গে করে।
পস্তাবি শ্মশানে যেদিন
ফেলবে তোরে
দিস নে আর আঁচির কড়ি
নাড়ার নাড়ী হও যেই রে।
ও তুই থাকবি ভালো
সর্বকালো যাবে দূরে
কুলমান সব যে জন বাড়ায়,
গুরু সদয় হয় না তারে।
লালন বেড়ায় ফাতরার
বেড়ায় কুল ঢাকে রে।

‘আঁচির কড়ি’ পাঠটিকেই আমি সর্বাপেক্ষা যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করি। ‘আদি মক্কা এই মানবদেহে’ এই মুখসংবলিত লালনের গানের ভণিতা নিয়ে আমার দ্বিতীয় উদাহরণ। আমি লালনের যেসব গানের সংকলন নিরীক্ষা এবং পর্যালোচনা করেছি, সেগুলোতে এই গানটির বেশির ভাগ ভণিতার পাঠ প্রায় একই। রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত খাতায় এ গানটি নেই। এই গানটির পাঠ যে বিকৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে বিখ্যাত বাউল-বিশেষজ্ঞ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও সন্দেহ করেননি। কিন্তু মৌখিক পাঠটি বাউল ধর্ম ও দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে অর্থপূর্ণ এবং লালনের অন্যান্য গানের সমর্থনপুষ্ট। গবেষকদের প্রকাশিত পাঠের বদলে মৌখিক পাঠটি প্রতিস্থাপিত করলে গানের মানে বদল হয়ে আসল অর্থ পাওয়া যায়। উক্ত সংকলনে (মতিলাল দাস ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র, ১৯৫৮: ২৯৫ নং গান; মুহম্মদ আবু তালিব, ১৩৭৫: দ্বিতীয় খণ্ড, ১৬১ নং গান; উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ১৩৭৮: ৪৩ নং গান) এ গানের ভণিতা মোটামুটি এইভাবে দেওয়া আছে:

ফকির লালন বলে সে যে
গুপ্ত মক্কা,
আদি ইমাম সেই মিঞে।

শ্রীযুক্ত ভট্টাচার্যের (১৩৭৮: ৩২৫) মতে ‘মিঞে’ হচ্ছে ‘খোদা’র একটি প্রতিশব্দ। আবার ব্রাদার জেমস্ তাঁর লালনের গানের ‘অনুবাদ’ সংস অব লালন (১৯৮৭: ৭৮-৭৯) গ্রন্েথ ‘মিঞে’ শব্দকে সম্ভবত ‘সাঁই’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে বিবেচনা করে সেটিকে ‘লর্ড’ হিসেবে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু ‘মিঞে’ অর্থাৎ ‘মিঞা’ (মিয়া) শব্দটি বাংলায় মুসলমানদের একটি সম্মানসূচক শব্দ। যদিও বড়জোর প্রাচীন ইংরেজি ভাষা অনুসারে ‘মিঞে’ শব্দটি ‘লর্ড’ বলে অনুবাদ করা যেতে পারে তবু এই শব্দটি বিশেষ কোনো বাংলা শব্দের সঙ্গে যুক্ত না হলে (যেমন ‘আল্লাহ্ মিয়া’) ‘গড’-এর অর্থে ব্যবহার মোটেই সমীচীন নয়।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাউল গায়ক মরহুম খোদা বক্সের পাঠ অনুযায়ী এই গানটিতে ব্যবহৃত ‘মিঞে’ শব্দটি আসলে ‘মেয়ে’। ‘মেয়ে’ কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘মিইঁয়্যে’, এমনকি ‘মিয়া’ হিসেবে উচ্চারিত হয়। ‘মিঞে’ (সম্মানসূচক উপাধি) এবং ‘মিইঁয়ে্য’র (অর্থাৎ ‘মেয়ে’র) মধ্যে ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকায় অনেকে ‘মিইঁয়ে্য’ কথাটিকে ‘মিঞে’ হিসেবে মনে করেছেন। শুদ্ধ ভাষায় গানটির ভণিতা হবে আসলে:

ফকির লালন বলে সে যে
গুপ্ত মক্কা,
আদি ইমাম সেই মেয়ে।

বাউল গায়ক আবদুল করিম শাহের কণ্ঠে এই পাঠের অবিকল একই শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। কৌতূহলবশত কুষ্টিয়ায় লালন ফকিরের আখড়া ছেঁউড়িয়ায় বেশ কিছু ফকিরকে এই ভণিতার পাঠের প্রকৃত শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। ওরা সবাই এই ব্যাপারে একমত। গানটির কলি হচ্ছে ‘আদি ইমাম সেই মেয়ে’। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতে চাই যে দুটি সংকলনে, যথাক্রমে ভাব সঙ্গীত (খোন্দকার রফিউদ্দিন, ১৩৭৪: ১৫, ৪০ নং গান এবং বাউল কবি লালন শাহ (আনোয়ারুল করীম, ১৩৭৩: ৩১৬, ১৯২ নং গান)—পরিষ্কারভাবে ‘মেয়ে’ শব্দটি রয়েছে, ‘মিঞে’ নয়। উপরন্তু যখন খোদা বক্সের আশ্রমে রক্ষিত খাতা দেখার সুযোগ পাই, তখন দেখি তাতেও ‘মেয়ে’ লেখা আছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে লালন-দর্শনে আশ্চর্যজনকভাবে আদি ইমামকে একজন শ্রদ্ধাস্পদ মহিলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য সবার কাছে ‘আদি ইমাম’ মহিলা, এই বিষয়টি বিসদৃশ বিবেচিত হলেও বাউল সম্প্রদায়ের কাছে এ হলো ‘শক্তি’র প্রতি তাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার প্রকাশ। এই শক্তিই হচ্ছে পরম করুণাময় আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। অথচ আরবি ভাষায় ‘ইমাম’ শব্দের অর্থ ধর্মীয় নেতা এবং সেই নেতা পুরুষ।

মুসলমান বাউলদের মধ্যে এই মর্মে বিশ্বাস রয়েছে যে ‘আদি শক্তি’ হচ্ছে হজরত আলীর সহধর্মিণী বিবি ফাতেমা। এ জন্যই লালন ফকির তাঁর ‘ভজ রে জেনেশুনে’ গানে বলেছেন, ‘নিলে ফাতেমার স্মরণ ফতে হয় করণ’। অর্থাৎ নিবিষ্টচিত্তে বিবি ফাতেমাকে স্মরণ করলে সাধন-সিদ্ধি হবেই। কেবল ‘শক্তি’র মাধ্যমেই পরম করুণাময় সাঁইয়ের দরবারে হাজির হওয়া সম্ভব।

ক্যারল সলোমন: সাবেক অধ্যাপক, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র; মার্চ ২০০৯-এ সড়ক-দুর্ঘটনায় নিহত।

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

লালন স্মরণোৎসব  ২০২৪
লালন স্মরণোৎসব ২০২৪

লালন স্মরণোৎসব ২০২৪

  • Sub Title: একদিনের দোল পূর্ণিমার লালন স্মরণোৎসব ২০২৪