সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ রূমী - নীলকুঠির সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন
সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ রূমী - নীলকুঠির সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন

লোক চক্ষুর আড়ালে যে সকল আউলিয়া ও দরবেশগন পুর্ব বাংলার অখ্যাত পল্লীতে এসে ইসলাম প্রচার করেছেন এবং সভ্যতা ও ইসলামিক কৃষ্টির নিদর্শন স্বরুপ বিভিন্ন আমানত আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, সেইসব হারিয়ে যাওয়া নিদর্শনের কিছু কিছু খোঁজখবর আজকাল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের বর্তমান ইতিহাসে এগুলির বিশিষ্ট স্থান থাকা দরকার।

বর্তমান হোসেনডাঙ্গা ইউনিয়নের অন্তর্গত সাজুরিয়া গ্রামে বহুকালের একটি লুপ্ত ইতিহাস আবিস্কৃত হয়েছে। সেখানে বিস্মৃতির গহবরে হারিয়ে যাওয়া দুটি আউলিয়ার মাজার আবিস্কৃত হয়েছে। একটি শাহ সৈয়দ আব্দুল্লাহ রুমী, অন্যটি শাহ জুবায়ের রুমীর।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে অনেক দরবেশ ও আউলিয়া ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে হিন্দুস্থান তথা বাংলাদেশে আগমন করেন। হযরত শাহ সৈয়দ আব্দুল্লাহ রুমী এদেরই একজন। এদের পুর্ব পুরুষদের আবাসস্থল ছিলো আরব দেশে। সেখান থেকে তাদের কেউ কেউ এশিয়া মাইনরের “এরজরুমী” নামক স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেন। সে কারনে এদের নামের শেষে রুমী শব্দটি লেখা হয়।

হযরত শাহ আব্দুল্লাহ রুমী দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন এবং বর্তমান চাটগা বা তার কাছাকাছি কোথাও অনেক আউলিয়ার সাথে পদার্পন করেন। তারপর সুমদ্র ও নদীপথ ধরে ভ্রমন করতে করতে পদ্মা ধরে উজান থেকে উঠে আসার সময় বর্তমান সাজুদিয়ার গ্রাম সেখানে একটি বালির চর ছিলো উনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। ক্রমে স্থানটির শ্রীবৃদ্ধি হয়। তিনি ঔ স্থানটিই ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রস্থল রুপে স্থির করেন।

যশোর জেলার শৈলকুপা [বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার অধীনে] মৌলভী আকবর হোসেন সাহেবের প্রচেষ্টায় সেখানে মাটির নিচে একটি পুরাতন সুদৃশ্য মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তারই প্রচেষ্টায় মুসলিম ঐতিহ্য এবং কুষ্টিয়ার বহু ইতিহাস পাওয়া গিয়েছে। সেখানকার দলিলপত্রেই শাহজীআরা গ্রামের নাম ও সেখান থেকে দরবেশ আউলিয়াদের ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পাওয়া যায়।

ইসলাম ধর্মের উদারতা, মহত্ব ও ভাতৃত্বে এবং দরবেশ আউলিয়াদের উন্নত চরিত্র এবং বিরাট ব্যাক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে এখানকার বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা ঘৃনিত, নিন্দিত, অবহেলিত ও পদদলিত নিম্ন শ্রেনীর হিন্দুরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন।

শাহজীআরা গ্রামকে কেন্দ্র করে দক্ষিনে শৈলকুপা, পুর্বে পদ্মা নদী ও পশ্চিমে কুমারখালী পর্যন্ত এই বংশের লোকেরা ইসলাম প্রচার করেন। রাজশক্তির আশ্রয় না নিয়ে সম্পুর্ন নিরাশ্রয় অবস্থায় এরা ইসলাম প্রচার করেন শুধু মহান আল্লাহপাকের নাম ভরসা করে।

আস্তে আস্তে কালের চাকা ঘুরে গিয়ে হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ভয়ানক দুর্দিন উপস্থিত হয়। অদুরদর্শি মুসলিম বাদশাহদের অকর্মণ্যতা ও অলসতার সুযোগ নিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটে বেনীয়া-ইংরেজ-ফরাসী ও ওলন্দাজদের। পরে বেনীয়া ইংরেজ বনীকের মানদন্ড রাজদন্ডে পরিনত হয়। মুসলমানেরা এর শাসন মেনে নিতে রাজি হয়নি। তাই ধুর্ত ইংরেজ সৃষ্টি করে একদল ঘৃনিত অনুগ্রহপ্রার্থী। আর তারই সাথে মুছে ফেলতে চেষ্টা করে মুসলিম সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। তারা এ কার্যে অনেকদুর পর্যন্ত কৃতকার্য হয়।

এরপর আসে সিপাহী বিদ্রোহ ও ওহাবী আন্দোলনের যুগ। সিপাহী বিদ্রোহে সারা ভারত দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। তার ঢেউ এসে লাগে শাহজীআরা গ্রামে। শাহ সৈয়দ জুবায়ের রুমী এতদাঞ্চলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। শক্তিশালী ইংরেজদের কামানের সামনে সামান্য তীর-ধনুক ও ওড়াল বাক নিয়ে আর কতকাল টিকে থাকা যায়। ইনি যুদ্ধে হেরে যান। এই যুদ্ধে তার একটি দান্দান শহীদ হন। সেই দান্দান গোর দেওয়া হয় বর্তমান কসবা মাজাইল ইউনিয়নের ভাতশালা গ্রামে। ঐ স্থানটি এখনও ভাতশালা গ্রামের দরগাবাড়ী নামে পরিচিত। এই বংশের শাহ সৈয়দ হুসাইন রুমী বর্তমান হোসেনডাঙ্গা গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকেন। গ্রামটির নাম প্রকৃতপক্ষে হোসেনডাঙ্গা নয়, তার নামানুশারে হোসেনপুর ছিলো। পুরাতন দলিলপত্রে ইহা পাওয়া যায়।

শাহজীআরা ও হোসেনপুর দুইটি পাশাপাশি গ্রাম। এখানে দুটি নীলকুঠি ছিলো। নীলকুঠির সাহেবেরা অযথা খুন যখম ও ব্যাভিচারে লিপ্ত থাকতো। এদের অকথ্য অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে স্থানীয় সরলপ্রান নিরীহ জনসাধারন হযরত শাহ হুসাইন রুমীর শরনাপন্ন হয়। তাই তিনি প্রতিবাদ করলেন। এতে সাহেবরা অগ্নীসর্মা হয়ে উঠলো এবং তাকে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চরম পত্র দিয়ে বসলো।

ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেবদের সাথে এখানে সৈয়দ হুসাইন রুমীর একটি ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে তিনি খন্দক তৈয়ারী করে তার ভেতর থেকে যুদ্ধ করেন এবং শাহাদাত বরণ করেন। খন্দকের বাংলা অর্থ গর্ত/গাড়া। এরপর থেকে ঐ গর্ত বা গাড়ার নামানুসারে গ্রামের নামকরন হয় হুসাইনগাড়া। পরে এই গর্ত বা গাড়া পলিমাটি পড়ে ডাঙ্গায় পরিনিত হয় বলে বহুকাল পরে আবার গ্রামের নামকরন করা হয় হুসাইনডাঙ্গা।

নীলকুঠীর সাহেবদের অত্যাচারে রুমী পরিবারের কেউ কেউ ভাতশালা গ্রামে আর কয়েকজন বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানার জানিপুর ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামে হিজরত করেন এবং ঐ দুটি গ্রামে হযরত শাহ সৈয়দ আব্দুল্লাহ রুমীর বংশধরেরা এখনও বসবাস করছেন।

এখন থেকে ১৫০ বছর পুর্বের একটি ঘটনার কথা লোক মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের ১৪ টি নীলকুঠীর ম্যানেজার ছিলো হ্যাম্পার্ড সাহেব। স্থানীয় কৃষকদের নিজের জমিতে নীল উৎপন্ন করে বিনা খরচায় সাহেবদের কুঠিতে পৌছে দিতে হত। না দিলে জীবন হানী পর্যন্ত হত। তাছাড়া সাহেবও ছিলো পাড় মাতাল। প্রতি রাতে কামলিলার খোরাক হিসাবে একটি সুন্দরী ললনাকে সাহেবের কুঠিতে তার সামনে পৌছে দিতে হত। অসহায় নিষ্পাপ অবলা ললনার ব্যাকুল ক্রন্দন আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে পল্লীর নিভৃত কন্দরে সরলপ্রান অসহায় জনসাধারনের মধ্যে ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করতো।

স্থানীয় জনসাধারন একরাতে গোপন বৈঠকে বসলো এবং পরবর্তি রাতে হ্যাম্পার্ড সাহেবকে সদলবলে হত্যা করে এবং তার লাশ তারই ঘোড়ার পিঠে বেধে বড় সাহেবের অফিসে পাঠিয়ে দেয়।

পরের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত। সাহেবরা ও তাদের আশ্রিত কতিপয় বর্ন হিন্দুরা এসে গ্রামটি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যায়। রামপ্রশাদ বিশ্বাস নামক জনৈক নমশুদ্র ভদ্রলোকের নেতৃত্বে সাহেবকে হত্যা করা হয়। এই রামপ্রসাদ বিশ্বাস বর্তমানকালের অভিমন্যু বিশ্বাসের পুর্বপুরুষ। এদের বাড়ী, পুকুর ইত্যাদি এখনও আছে। বহুকাল পদ্মার পলিমাটি পড়ে স্থানটি শস্য উৎপাদনের উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় আবার জনপদ গড়ে উঠে এবং তখনই গ্রামটির নাম হয় হুসাইনডাঙ্গা।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অংশ গ্রহন করার জন্য এই পরিবারের একজনের ফাঁশি হয়। মোঘল সম্রাটদের সময় রুমী পরিবারের পুর্বপুরুষদের লাখেরাজ জমি হিসাবে এক হাজার বিঘা জমি প্রদান করা হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি আমলে খোকসা কুমারখালী অংশ তাদের অধীনে ছিলো।

খাজনা দিতে দেরী হলে জমদারের লোকজন হাতি দিয়ে প্রজাদের ঘরবাড়ী ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিত। সেই সময় জমিদারের পাইক, পেয়াদা, নায়েবের অত্যাচারে জনগন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে সৈয়দ কামাল উদ্দিন রুমী সাহেবের কাছে এসে এর প্রতিকার চায়।

সৈয়দ কামাল উদ্দীন রুমী সাহেব সমগ্র জনগনকে একত্রিত করে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এসে কামাল উদ্দীন রুমী সাহেবের আহবানে প্রজাগন জমিদারের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

জোড়াসাকোর জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে খবর গেলে তিনি সশরীরে বিষয়টি দেখার জন্য খোকসা চলে আসেন। আলোচনায় বসেন এবং প্রজাদের খাজনা কমিয়ে দেন, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেন এবং একটি মৌজার নাম কামাল উদ্দীন রুমীর সাহেবের নামে নামকরন করেন যেটা বর্তমান কামাল উদ্দীন মৌজা। কামাল উদ্দীন রুমী সাহেবের দাবী অনুযায়ী এখানে জমিদারের কাচারী স্থাপিত হয়।

প্রায় ১০০ বছর আগে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুসলিম জনগনের জন্য “আঞ্জুমানে ইত্তেফাকে ইসলাম” নামে একটি সংগঠন সারা ভারতবর্ষে গঠিত হয়। তার সভাপতি রুমী পরিবারের জ্ঞাতি ভাই সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস রুমী এবং স্যার আজিজুল হক তার সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।

সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ রুমীর বংশ তালিকা ও তাদের পরিচয়:
সৈয়দ কামাল উদ্দিন রুমীর পুত্র।
সৈয়দ গোলাম হোসেন রুমী।
তার পুত্র সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ রুমী ( যে কংগ্রেস সমর্থক ও পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন)
সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ রুমীর বংশধর -
পুত্র সৈয়দ আহমাদ রুমী
পুত্র সৈয়দ মামুন রুমী
পুত্র সৈয়দ মাসউদ রুমী
পুত্র সৈয়দ মাহাবুব রুমী
সৈয়দ আহমাদ রুমী - ঢাকা হাইকোর্টে কর্মরত ছিলেন।
সৈয়দ মামুন রুমী - ছাত্রজীবনে কংগ্রেস করতেন। কর্মজীবনে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটারস লিমিটেড এ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে লন্ডন, বোম্বে ও কলকাতায় কর্মরত ছিলেন।
সৈয়দ মাসউদ রুমী - আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, খোকশা কুমারখালী অঞ্চল থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সৈয়দ মাহবুব রুমী এস,ডি,এম রেভিনিউ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ