সাহিত্যিক মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা
সাহিত্যিক মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (জন্মঃ ১৬-১২-১৯০৬ মৃত্যুঃ ০২-০৫-১৯৭৭) সাহিত্যিক। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়া জেলার নিয়ামত বাড়ী গ্রামে। জন্ম পাবনায়, পিতা খানবাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান ছিলেন একজন বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক এবং মা সৈয়দা রাহাতুননেসা খাতুন ছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী। ছয় বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাহমুদা ছিলেন দ্বিতীয়। কৈশোরে রচিত কবিতা ও রূপকথায় তাঁর নাম পাওয়া যায় শ্রী রকিবননেছা মহম্মদা খাতুন। তাছাড়া সে সময়ে তাঁর ডাক নাম ছিল বাতাসী।

বাঙালী মুসলিম মহিলা কবিদের অন্যতম কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলার মুসলিম নারী কবিদের মধ্যে ইতিহাসে যাঁরা অমরত্ব লাভ করেছেন কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা তাঁদের মধ্যে অন্যতম যিনি সরাসরি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। মাহমুদা খাতুন ধার্মিক ও কলকাতার পীর সাহেবের মুরিদ হওয়া সত্বেও কুসংস্কার, পর্দা, অশিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন সব সময়। মুসলিম বাঙালী মহিলা কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম সনেট ও গদ্য ছন্দে কবিতা লিখেছেন। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পসারিণী প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরশমনি কাব্যগ্রন্থের পূর্বে আর কোন বাঙালী মুসলিম মহিলা কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।

মাহমুদা খাতুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। আকৈশোর ছবি অাঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। পরবর্তীকালে তিনি স্বাস্থ্যরক্ষা ও রন্ধনশিক্ষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন। পারিবারিক পরিবেশ ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার অনুকূলে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান ছিলেন তাঁর গৃহশিক্ষক। কায়কোবাদের অশ্রুমালা ও সমকালীন সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত রচনাবলি তাঁকে প্রভাবিত করে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। পিতার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেছেন। এক সময় তিনি জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং কিছুকাল অবস্থান করেছেন। তাছাড়া দিল্লি, আগ্রা, আজমির প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেছেন।

বিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক জাগরণে নারীর অবস্থান যাঁরা নিশ্চিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। এক্ষেত্রে স্বনামধন্যা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ ও সুফিয়া কামাল-এর পর্যায়ভুক্ত ছিলেন তিনি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত না হলেও সৃজনশীল মন ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনন দিয়ে তিনি স্বকালের স্বসমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

মাহমুদা খাতুনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি: পশারিণী (১৩৩৮), মন ও মৃত্তিকা (১৯৬০) এবং অরণ্যের সুর (১৯৬৩)। এছাড়া কিছু প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও তিনি রচনা করেছিলেন, কিন্তু সেগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তিনি মুখ্যত কবিতাই লিখেছেন। স্বভাবজাত প্রেরণায় মাহমুদা খাতুন অনবরত কবিতা লিখেছেন এবং সেগুলি সমকালীন সাময়িক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কাব্যপ্রতিভা হয়তো তাঁর কর্মখ্যাতির সমতুল্য ছিল না, কিন্তু নিষ্ঠা ও প্রয়াস তাঁকে রবীন্দ্রানুসারী কবিদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট আসনে সমাসীন করেছে।

মাহমুদা খাতুন সনেট এবং গদ্যছন্দেও কিছু কবিতা রচনা করেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মানুষ ও সমাজ তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও সাময়িক প্রসঙ্গ হয়েছে তাঁর কবিতার বিষয়বস্ত্ত। দুই মহাযুদ্ধের তান্ডবলীলা তাঁকে শান্তির অনিবার্যতায় আস্থাশীল করেছে। তাই শান্তির স্বপক্ষে তিনি আহবান জানিয়েছেন উদাত্ত কণ্ঠে। যেহেতু তাঁর কাছে কবিতা ছিল ‘হূদয়ের বিশুদ্ধ উচ্চারণ’, সেহেতু তাঁর নিজের কবিতাও ছিল মৌলিক এবং এক প্রশান্ত গতিপথে প্রবহমান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

‘... বিশ্বকবির পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করলাম। আমি সেলাম করে উঠলে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা সারলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিকিরণ হতে লাগলো। তার পরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন, “তোমরা যে পর্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্য্যরে কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না, ফল-ফুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলো-বাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে ঊর্ধ্বে উঠেই সূর্য্যরে কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।’

নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘বাল্যকালে কবির বিবাহ হয় কিন্তু তাঁর বিবাহিত জীবন খুব স্বপ্নকাল স্থায়ী। তিনি স্বামীগৃহে যাননি, বিবাহিত জীবন উপভোগ করেননি। সকলে তাঁকে চিরকুমারী বলেই জানে।’

মাহমুদা খাতুন বহু সাহিত্যসভায় অংশগ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলাম-এর স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগও তাঁর ঘটেছিল। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবনযাপন তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে ভূষিত করে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ১৯৭৭ সালের ২ মে ঢাকায় মৃত্যুৃবরণ করেন।

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য