প্রথম সারির সর্ব বামে
প্রথম সারির সর্ব বামে

মৌলভী শামসুদ্দিন আহমেদ (জন্মঃ আগস্ট ১৮৮৯, মৃত্যুঃ ৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) অবিভক্ত বাংলার প্রথম মন্ত্রী। আজীবন সংগ্রামী, সাধারণ মানুষ তথা শ্রমিক-কৃষকের বন্ধু, অবিভক্ত বাংলার প্রথম মন্ত্রী, কৃষক প্রজা আন্দোলনের নেতা নিখিল বাংলা খেলাফত পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী মৌলভী শামসুদ্দিন আহমেদ।

কুষ্টিয়ার কৃতি সন্তান অবিভক্ত বাংলার প্রথম বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী এবং হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার যোগাযোগ ও পূর্ত মন্ত্রী মৌলভী শামসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের মূল উদ্যোক্তা এবং তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ১৯৪৬ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ও আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি জনহিতকর কাজ, শিক্ষা-দীক্ষা এবং সাহিত্যের প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্রোহ কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে বিখ্যাত কৃষক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন- সে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা তাঁর মন্ত্রী থাকাকালীন পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনারই অংশ ছিল ঢাকা-আরিচা সড়ক ও চট্টগ্রাম-টেকনাফ সড়ক। আজকের কাপ্তাই বিদ্যুত প্রকল্পও তাঁর মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের পরিকল্পনা।

মৌলভী শামসুদ্দিন আহমদের জীবন কর্মবহুল। আজীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ সমাজসেবক। তাঁর ও তাঁর কালের অবদান আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমি রচনা করেছে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত প্রাণ এই রাজনীতিবিদের মূল্যায়ন আজও হয়নি। মৌলভী শামসুদ্দিন আহমদ ১৮৮৭ সালের আগষ্ট মাসে কুমারখালীর সুলতানপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মাহতাব উদ্দিন ছিলেন সমাজ সংস্কারক।

শামস উদ্দিন আহমদ হুগলী মাদ্রাসা থেকে পাস করে কলকাতায় পড়াশুনা করেন। ১৯১০ সালে কলকাতা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯১৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও বিএল ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে কৃষ্ণনগরের জেলা আদালত ও ১৯১৯ সালে কলকাতা হাইকোর্টে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জুনিয়র হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু জন্ম যার দেশের আপামর মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার জন্য, পেশা তাকে আটকে রাখবে কেন? মৌলভী শামসুদ্দিন আহমদ ১৯২০ সালে ‘খেলাফত আন্দোলন’-এ যোগ দেন।

এ সময় কুষ্টিয়া জেলাসহ সমগ্র বঙ্গদেশে খেলাফত আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। এ আন্দোলন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনে তার অগ্রজ মৌলভী আফসার উদ্দিন আহমদও জড়িত হন এবং তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এই আন্দোলনে শামসুদ্দিন আহমদের সাথে এই জেলায় এক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা হলেন- আফছারউদ্দীন আহমদ, হেমন্ত কুমার সরকার, সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী, ফতেহ চাঁদ নাইটা প্রমুখ। খেলাফত আন্দোলনের অগ্রণী ভারতের ‘আলী ভ্রাতৃদ্বয়’ এর মতো তাঁদেরকে ‘আহমদ ভ্রাতৃদ্বয়’ বলা হতো।

১৯২২ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মৌলভী শামসুদ্দিন আহমদ ব্যাপকভাবে রাজনীতি ও সমাজ কর্মে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন। এখানে তার উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের ছোট্ট বিবরণ দেয়া হলোঃ

  1. ১৯২০ সালে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দান
  2. ১৯২২ সালে বঙ্গীয় কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সম্পাদক
  3. ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ
  4. ১৯২৮ সালে টাটা কোম্পানীর গোলযোগ দমনে নেতাজী সুভাষ বসুর সঙ্গে ভূমিকা গ্রহণ
  5. ১৯২৯ সালে মৌলানা আবুুল কালাম আজাদ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন ও সম্পাদক পদে নিযুক্ত
  6. ১৯৩৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের সদস্য নির্বাচনে জয়লাভ
  7. ১৯৩৬ সালে শেরেবাংলার সভাপতিত্বে গঠিত নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত
  8. ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের আওতায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৪২টি আসনে জয়লাভ
  9. ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা সমিতির প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচনে জয়লাভ
  10. ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকের মন্ত্রী সভায় প্রথম অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী নিযুক্তি
  11. ১৯৩৯ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রী সভা থেকে নীতির প্রশ্নে পদত্যাগ
  12. ১৯৪২ সালে সামা হক মন্ত্রী সভায়, গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন
  13. ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগে যোগদান ও নির্বাচনে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রী সভায় শিল্প বাণিজ্য-শ্রমমন্ত্রীর দিয়িত্ব পালন
  14. ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খানের আমলে বার্মার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের বৈষম্যমূলক আচরণে রাষ্ট্রদূত পদ থেকে পদত্যাগ
  15. বঙ্গীয় জমিদারী প্রথা বিলোপ আইন প্রণয়নে ক্লাউড কমিশন গঠন এবং প্রজা সমিতি পরিচালনায় শামসুদ্দিন আহমদ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।

তিনি ১৯৬৯ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। কয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ্ গোরস্থান ময়দানে তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে পাঁচ পুত্র ও চার কন্যা রেখে যান। তিনি রাজনীতিতে যে আদর্শ রেখে গেছেন তা শ্রদ্ধা ভরে দেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ করবে। সাধারণ কৃষকদের জন্য তিনি কাজ করায় এদেশের কৃষকের হৃদয়ে হাজারও বছর বেঁচে থাকবেন।

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ