আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে প্রবিত্র রমজান মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

টেগর লজ
টেগর লজ

সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়াতে বিশ্ব কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজ হাতে নির্মিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘টেগর লজ’। ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ও তার দুই ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ এর সহায়তায় শিলাইদহে টেগোর এন্ড কোম্পানী গড়ে তোলেন যৌথ মুলধনী ব্যবসা।

সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগর এন্ড কোম্পানী শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানী দেখাশুনার জন্য কবি শহরের মিলপাড়ায় ক্ষণকাল থাকার প্রয়োজনেই তৈরি করেছিলেন এই টেগর লজ নামের দোতলা বাড়িটি।

কালের বিবর্তনে একপর্যায়ে টেগর লজ বেদখল হয়ে যায়। বহু হাত বদল হয়ে অবশেষে এর মালিকানা এসে পৌঁছায় স্থানীয় আবদুল গফুরের স্ত্রী ছালিমা খাতুনের নামে। আশপাশের জমিও চলে গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে। তাঁরা নিজেদের নামে কাগজপত্র করে নিয়েছেন। এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কবির স্মৃতিধন্য বাড়িটিকে রক্ষার উদ্যোগ নেন কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়াম্যান মোঃ আবদুর রহিম।

বাড়িটি পৌরসভার নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তিনি উচ্চমহলে দেন-দরবার করতে থাকেন। এরই একপর্যায়ে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়া সফরে এলে তিনি টেগর লজ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করার আবেদন জানান। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর স্মৃতিধন্য বাড়িটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। কিন্তু বাড়িটির মালিকানা যেহেতু ব্যক্তি পর্যায়ে, তাই পৌরসভাকে হস্তান্তর করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর টেগর লজ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পৌরসভার বর্তমান মেয়র আনোয়ার আলী ১৯৮০ সালে আবার বাড়িটি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু আবার সেই জটিলতা। এক পর্যায়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেয়া হয়। এরপর শুরু হয় সংস্কার কাজ। বর্তমানে বাড়িটি কুঠিবাড়ি ন্যায় রং করা হয়েছে। বাহিরের দেওয়ালে তাঁর কবিতা অংকন করা আছে।

বাড়িটি শহরের মিলপাড়ায় বড় ষ্টেশন থেকে দুইশ মিটার অবস্থিত। জায়গা খুব বেশি নয়, সাকল্যে নয় কাঠা। তার ওপরে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। উত্তর-দক্ষিণ দুই পাশেই বারান্দা। পশ্চিম পাশের কুঠুরির কোণে দোতলায় ওঠার প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি। বাড়িতে প্রবেশের পথ অবশ্য উত্তর দিকে। একেবারে মিলপাড়ার সড়কের সঙ্গে লাগোয়া। ছোট্ট বাড়িটি মাপে ছোট হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য হওয়ার কারণে মর্যাদা ও গৌরবে এক বিশালতা জুড়ে থাকলেও কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির যেমন বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি, সে তুলনায় শহরের ভেতরের এই বাড়িটি এখনও প্রায় অপরিচিতই বলা যায়।

ভুসিমালের কারবারের সঙ্গে এখানে কবি আখ মাড়াইকল ও পাটের গাঁট তৈরির কলও স্থাপন করেছিলেন। পরে স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় টেগর লজকে কেন্দ্র করে একটি বড় তাঁতশালাও গড়ে তোলেন। প্রথমটায় ব্যবসা ভালো চললেও পরে টেগর অ্যান্ড কোম্পানি ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। পাটের কারবার করতে এসে কবি লাখ টাকার ওপরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহির উদ্যমী যুবক যজ্ঞেশ্বরকে ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব দেন। যজ্ঞেশ্বর বহু খেটেখুটে ডুবতে বসা টেগর অ্যান্ড কোম্পানিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে কবি তিন হাজার টাকায় যজ্ঞেশ্বরকে কোম্পানির সমুদয় যন্ত্রপাতি ও মালামাল দান করে দেন এবং টেগর লজসহ এখানকার দুই বিঘা জমি বছরে ৫০ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত করে দেন। পরে যজ্ঞেশ্বর এখানে ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন (কারখানা ভবনটি এখনো আছে)। তারপর তো কেটে গেছে বহু দিন। নিচের তলায় একটি বড় হলঘর ও একটি ছোট ঘর। ওপরে ঘর তিনটি। ওপরের তলায় মাঝের ঘরটি বড়। এখানে একটি আলমারিতে রাখা আছে কবির রচিত গ্রন্থমালা। দেয়ালে ঝোলানো কবির আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি।

দক্ষিণে সবুজ ঘাসে ঢাকা একচিলতে আঙিনা। সেখানে ছোট্ট একটি মঞ্চও আছে। উত্তরের প্রবেশ পথের সামনেই কবির আবক্ষ মূর্তি। এই মূর্তি ও ছবির অনুকৃতিগুলো ভারতীয় দূতাবাস দান করেছে বলে জানালেন টেগর লজের তত্ত্বাবধায়ক এস এম নূরুদ্দিন। ওপরতলায় আসবাবের মধ্যে আছে কয়েকটি চেয়ার ও হেলান দিয়ে বসার একটি লম্বা বেঞ্চ। এগুলো শিলাইদহের আসবাবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। জরাজীর্ণ দেয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিল না বাড়িটিতে। কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী বললেন, ‘শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সুপরিচিত হলেও টেগর লজকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে কবির যে সম্পর্ক, তা অনেকেরই অজানা। ফলে টেগর লজ আজও উপেক্ষিত। টেগর লজকে অনতিবিলম্বে রবীন্দ্র জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তিনি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রলালয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে ঘিরে কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাদপীঠ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। কুষ্টিয়ার প্রবীণদের নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে প্রবীণ সংঘ। প্রবীণরা সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা করে। রবীন্দ্রবিষয়ক গবেষণাধর্মী কোন কিছু গড়ে উঠেনি বলে এলাকাবাসী জানান। কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী জানান, অচিরেই টেগর লজকে রবীন্দ্র গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

কবি যখন ট্রেনে চেপে কলকাতা থেকে আসতেন বা কলকাতা যেতেন, তখন শিলাইদহ যাতায়াতের সময় টেগর লজে বিশ্রাম নিতেন। অনেক সময় রাতযাপনও করেছেন। ব্যবসায়িক কাজের তদারক করেছেন এখানে থেকেই। তিনি কুষ্টিয়া রেলস্টেশন-সংলগ্ন বসন্তের ফুলে ভরা একটি কুরচি গাছ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। ১০ বৈশাখ ১৩৩৪-এ লিখিত ‘কুরচি’ নামে এই কবিতা পরে বনবাণী বইয়ে গ্রথিত হয়।’ খোকসা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও রবীন্দ্র গবেষক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তাই তাঁর স্মৃতিবিজড়িত টেগর লজ বাড়িটির ঐতিহ্য ও সন্মান ফিরিয়ে আনার জন্য কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি অবিলম্বে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তর করলে ভালো হতো বর্তমানে কুষ্টিয়া পৌরসভার অধীনে আছে।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.