বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার
বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

হানিফউদ্দিন মিয়া (Hanifuddin Mia) বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটারটি আসে ১৯৬৪ সালে [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে]। সেটি ছিল আইবিএম মেইনফ্রেম ১৬২০ কম্পিউটার। বৃহদাকৃতির ওই কম্পিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাউস আকারের সেই কম্পিউটারটিকে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ডিজিটাল মেইনফ্রেম কম্পিউটার। এখানে বিশেষ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০ তার হাত ধরেই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে [টিএসসি সংলগ্ন] স্থাপিত হয়।

পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এবং দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, প্রোগ্রাম উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং নানামুখী গবেষণা কাজে এটি ব্যবহার করেন। তবে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটারটি কেন স্থাপিত হয়েছিল তা জানা প্রয়োজন। মোস্তাফা জব্বার জানান, পাকিস্তান সরকার তখন কম্পিউটারটি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপনের পরিকল্পনা করে। তবে হানিফউদ্দিন মিয়া ছাড়া অন্য কেউ এ কম্পিউটার তদারকি এবং পরিচালনার যোগ্য ছিলেন না। এজন্য সরকার হানিফউদ্দিন মিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আহ্বান জানাল। তবে ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন হানিফউদ্দিন। ফলে কম্পিউটারটি ঢাকার আণবিক কমিশনে স্থাপনে অনেকটা বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।

এখনকার সময়ে বিদেশ মানেই স্বর্গ। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য পাকিস্তানই ছিল স্বর্গ। কিন্তু হানিফউদ্দিন সেই স্বর্গের হাতছানি প্রত্যাখ্যান করেন। এ দেশে ক'জন এমন মানুষ ছিল বা আছে?

কম্পিউটারের সঙ্গে সখ্য হলো কিভাবে হানিফ উদ্দিন মিয়ার এটি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে তার তারুণ্যে। বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষক পিতা রজব আলী তালুকদারের দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন, চেকোসেস্নস্নাভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে অ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

হানিফউদ্দিন মিয়া (Hanifuddin Mia) - বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

১৯৬৪ সালে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি [যুক্তরাষ্ট্র] কম্পিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় [ওঅঈঊ] প্রোগ্রামার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইমপ্লিমেশন অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামসংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম ও এক পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো. হানিফউদ্দিন উদ্দিন মিয়া। পুত্র শরীফ হাসান দীর্ঘ ২৩ বছর সিমেন্স বাংলাদেশে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাউজিং কোম্পানিতে কাজ করছেন। অন্যদিকে তার মেয়ে ডোরা শিরিন পেশায় একজন ডাক্তার। আর অপর মেয়ে নিতা শাহীন গৃহিণী। পারিবারিক জীবনে তিনি এক পুত্র ইঞ্জিনিয়ার মো. শরীফ হাসান ও দুই কন্যা ড. ডোরা শিরিন ও নিতা শাহীনের জনক। নাটোর জেলার হুলহুলিয়া গ্রামের এই কৃতী সন্তান বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স ও নিউমেরাল ম্যাথেমেটিকস থাকা সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্যসহ আরও নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ।

তিনি বাংলা ও ইংলিশ ছাড়াও উর্দু, আরবি, হিন্দি, জার্মান ও রাশিয়ান ভাষা জানতেন। এদিকে ২০০১ সালে দেশে ব্যবহূত প্রথম কম্পিউটারটিকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এর এক বছর আগে ২০০০ সালে নিজ গ্রাম হুলহুলিয়া হাইস্কুলে দুটি আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটার উপহার দেন তিনি। এরপর থেকেই এই গ্রাম থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কম্পিউটার প্রকৌশলীর সংখ্যা। ছোট্ট এ গ্রাম থেকে বেড়ে উঠেছেন শতাধিক প্রকৌশলী। ২০০৭ সালের ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে মৃত্যুুর পূর্বে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়ার নাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

হানিফউদ্দিন মিয়াকে নিয়ে মোস্তাফা জব্বার খুব ছোট স্মৃতিচারণ রয়েছে। '৯৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম আমাকে কম্পিউটারবিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করার অনুমতি প্রদান করে। বাংলাদেশে কম্পিউটার নিয়ে এর আগে আর কোন অনুষ্ঠান হয়নি। এর আগেও এমন একটি অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করে আসছিলাম। কিন্তু '৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকার আমাকে পছন্দ না করায় এবং '৯৬ পরবর্তী সরকারের সহানুভূতি পাওয়ায় বিটিভির একজন প্রখ্যাত প্রযোজককে আমার এ অনুষ্ঠানটি করতে দেয়া হয়। সেই প্রযোজক লুৎফর রহমান তালুকদার এখন আর বিটিভিতে নেই। তবে তার সহকারী বরকত এখনও আমার কম্পিউটার অনুষ্ঠান করে। বরকত সেই অনুষ্ঠানের কথা এখনও মনে করতে পারে। এই অনুষ্ঠানটি বরাবরই শিক্ষামূলক। তবে প্রথম কয়েকটি অনুষ্ঠান আমি একটু ভিন্নমাত্রার করার কথা ভাবি। সেজন্যই আমি '৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই। তখন জানা গেল কম্পিউটারটি সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনে আছে। আমরা যেখানে যাব ভাবলাম। লুৎফর ভাই বিটিভির আউটডোর ক্যামেরা ইউনিট বরাদ্দ নেন। আমি চাইলাম, সেই কম্পিউটার যিনি প্রথম ব্যবহার করেন তার একটি সাক্ষাৎকার নেব। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রথম সভাপতি এসএম কামালের কাছে খোঁজ পেলাম মো. হানিফউদ্দিন মিয়ার। পরে জানলাম বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির দ্বিতীয় সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনের ভায়রা তিনি। সাজ্জাদ ভাই পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন এবং হানিফউদ্দিন সেই বিয়ের অনুঘটক ছিলেন।

সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশের কম্পিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইলফলক কারণ হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এদেশে কম্পিউটার আসার কথা। আমি অবাক হয়েছিলাম এটি জেনে যে তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কম্পিউটারটি পাই। আমি স্মরণ করতে পারি, ভিডিও ক্যামরায় সামনে সেটি তার প্রথম কথা বলা। অনেকটাই লাজুক টাইপের এ মানুষটির ব্যবহার এতটাই অমায়িক ছিল যে আমি অভিভূত হয়ে যাই।

এরপর বহুদিন তার খবর রাখিনি। কামাল ভাই কম্পিউটার সমিতির আশপাশে থাকলেও সাজ্জাদ ভাই অনেকটা দূরে সরে যাওয়ায় আমি আর তার খবর নিতে পারিনি। আমি জানতাম, তিনি উত্তরায় থাকেন। আর কোন সংযোগ আমার ছিল না।

এ বছরের শুরুতে আমি সাভারের পিএটিসিতে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি ব্যাচের ক্লাস নিতে গেলে সেখানে আমি হানিফউদ্দিনের কথা বলি। বস্তুত আমি '৯৭ সালের পর যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই হানিফউদ্দিন মিয়ার কথা বলেছি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার পর এক তরুণ এসে জানাল তার বাড়ি হুলহুলিয়া গ্রামে, যে গ্রামে হানিফউদ্দিন জন্ম নিয়েছেন এবং যেখানে তার কবরও আছে। আমি তার কাছে হানিফউদ্দিনের বংশধরদের কারও ঠিকানা চাইলাম। তিনি তার ছেলে শরীফ হাসান সুজার ফোন নাম্বার ও বাসার ঠিকানা দিলেন। সেদিন মনে হলো হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম।

এমনিতেই ২০১৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি থাকাকালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর উদযাপনের জন্য চেষ্টা করি। তার আগে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির ২৫ বছর উদযাপনের জন্যও চেষ্টা করি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আমার সহায়ক হয়নি। তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে আর কিছু না হোক দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষদের কাছে অন্তত হানিফউদ্দিন মিয়ার নামটা পেঁৗছানো দরকার। এক কথায় যদি বলি তবে এর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সবার দুয়ারে দুয়ারে আমি ঘুরেছি। একেবারে শেষ চেষ্টাটি কাজে লেগেছে। এবার আইসিটি ডিভিশন ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি যখন বাংলাদেশ আইসিটি এঙ্পোর আয়োজন করে তখন কোন এক কারণে আমি সেমিনার কমিটির চেয়ারম্যান হই।

সেই সুবাদে এ ডিভিশনের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলকের সঙ্গে কথা হয়। পলককে হানিফউদ্দিনের কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এতে সম্মতি প্রদান করেন। এ ডিভিশনের কর্মকর্তারা আমার ঘাড়ে একটি বাড়তি দায়িত্ব দিলেন- তার পরিবারকে খুঁজে বের করার। আমি সেই কাজটিও করলাম। জানা গেল যে, তার স্ত্রী মারাত্মকভাবে অসুস্থ। সম্মাননা দেয়ার আগের রাতে আমি সেই মহিলার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আসতে রাজি হননি। কিন্তু একরকম জোর করেই আমি তাকে রাজি করালাম এবং সেদিন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে শুধু তিনি আসেননি তার তৃতীয় প্রজন্ম ছেলের ছেলে নাতি ইরফানকেও নিয়ে এলেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক ঘটনা। ইরফান সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমি জানতাম না আমার দাদা এত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সত্যিকার অর্থে আমরাও জানতাম না তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

প্রযুক্তি এর নতুন প্রবন্ধ