আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

বাংলা গানের আকাশে আব্দুল জব্বার মহাতারকার মত জ্বলবেন অনন্তকাল
বাংলা গানের আকাশে আব্দুল জব্বার মহাতারকার মত জ্বলবেন অনন্তকাল

বাংলা গানের কিংবদন্তি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক আব্দুল জব্বারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে মহান এই শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর একমাত্র অ্যালবামের গীতিকার মোঃ আমিরুল ইসলাম।

নন্দিত সঙ্গীত শিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার হলেন বাংলা সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ, বাংলা গানের কিংবদন্তি। তাঁর মাতাল কণ্ঠের মাদকতায় মোহাবিষ্ট হত অসংখ্য দর্শক-শ্রোতা। তাঁর হাত ধরে বাংলা গান পেয়েছিল পূর্ণতা, পৌঁছেছিল অনন্য এক উচ্চতায়।

২০০৮ সালের কথা। আমার লেখা ‘এখানে আমার পদ্মা মেঘনা’ গানটিতে আব্দুল জব্বার কণ্ঠ দেন। রেকর্ডের পর স্টুডিওতে বসে তিনি মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার গানটি শুনে এতই মুগ্ধ হন যে আমাকে একটি অ্যালবামের জন্য গান লিখতে বলেন। পরবর্তীতে এই গানটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় গান হয়ে উঠেছিল। টিভি শো থেকে স্টেজ শো – কোথাও তিনি গানটি গাইতে ভোলেন নি। এই গানটি তাঁর গাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান ছিল। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে গানটি সম্পর্কে তিনি এমনটিই মন্তব্য করেন। আমি অ্যালবামের জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকের গান লিখলাম। একটি গানের কথা ছিল এরকম - ‘আমাকে তোমাদের ভালো না লাগলেও আমার এই গান ভালো লাগবে’। গানটি পড়ে জব্বার ভাই আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, ‘শুধু আমার কথা নয়। প্রতিটি শিল্পীর মনের কথা লিখেছ’। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরে তাঁকে শহীদ মিনারে নেয়ার সময় যেন গানটি বাজানো হয়। গোলাম সারোয়ার ভাইয়ের সুর ও সঙ্গীতে ২০০৯ সালে অ্যালবামের কাজ শেষ হলেও অ্যালবাম রিলিজের বিষয়ে জব্বার ভাই উদাসীন ছিলেন। মনে মনে আমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলাম। তাছাড়া তাঁর স্বাস্থ্য দিন দিন ভেঙে পড়ছিল। একদিন তাঁর ভুতের গলির বাসায় গিয়ে অ্যালবাম প্রকাশের ব্যাপারে কথা বললাম। তিনি জানালেন যা ভালো হয় তাই যেন করি। শুরুতে অ্যালবামের নামকরণ ‘মা আমার মসজিদ মা আমার মন্দির’ করা হলেও জব্বার ভাইয়ের ইচ্ছেতে অ্যালবামের নাম পরিবর্তন করা হল। অবশেষে গত বছরের এপ্রিল মাসে বহু আকাঙ্খিত এই অ্যালবামটি ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ শিরোনামে আলোর মুখ দেখল। বাংলা গানের ইতিহাসে যুক্ত হল শিল্পী আব্দুল জব্বারের প্রথম এবং একমাত্র মৌলিক গানের অ্যালবাম। আমি হয়ে উঠলাম আব্দুল জব্বারের গীতিকার।

গান লেখার সুবাদে আমি আব্দুল জব্বারকে খুব গভীর থেকে দেখেছি। তাঁর সমগ্র সত্তায় বসবাস করতেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। আর সেকারণেই বোধ করি যুদ্ধের সময় বোম্বের একজন প্রথিতযশা গীতিকার আব্দুল জব্বারকে হিন্দি সিনেমায় প্লেব্যাক করার প্রস্তাব দিলে তিনি সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বরং জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হবে, বাবা (বঙ্গবন্ধু) কবে মুক্তি পাবে। তাঁর এই নির্মল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের মন্ত্র-বলেই একাত্তরের দিনগুলিতে তিনি মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুদ্ধের শিবির থেকে শিবিরে বীরের বেশে দাপিয়ে বেড়াতে পেরেছিলেন। কণ্ঠকে পরিণত করেছিলেন হাতিয়ারে, সুরকে রূপান্তরিত করেছিলেন শক্তিতে। দীপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম, মুজিবুর’।

বর্তমান সময়ের গীতিকার হিসেবে আব্দুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত শিল্পী। নতুনদের তিনি উৎসাহ দিতেন। আমাকে তিনি মাঝে মধ্যে বলতেন, ‘আমিরুল, তোমার লেখার হাত ভাল। গান লেখা ছেড়োনা’। পরিচয় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনদিন তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের ছেদ ঘটেনি। এই সুদীর্ঘ সময়ে আমার মনের মাঝে জমে আছে তাঁর অসংখ্য স্মৃতি। সেসব স্মৃতি কোলাহল করে সর্বদা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

শিল্পী আব্দুল জব্বারের গান ভালবাসেননি এমন লোক কমই আছেন । সাধারণ শ্রোতা থেকে শুরু করে সঙ্গীত বোদ্ধারা সকলেই তাঁর দরাজ কণ্ঠের ছোঁয়ায় বিমোহিত হতেন। মহানায়ক উত্তম কুমার পর্যন্ত আব্দুল জব্বারের গাওয়া গানে রূপালি পর্দায় লিপসিং করতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। আব্দুল জব্বার ছিলেন এমনই এক মহান শিল্পী।

‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’। কবির মত আব্দুল জব্বারও মরতে চাননি। এই বাংলার আলো বাতাসে নদী মাঠে ঘাসে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। শরতের সকালের ঝমঝম বৃষ্টি আর অগণিত ভক্তদের শেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত সাদা কাফন মোড়ানো তাঁর নিথর অলস দেহটি যখন শহিদ মিনারের বেদি থেকে সমাহিত করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পাথরের মত নিশ্চল বোবা চোখে অস্ফুট স্বরে বার বার তিনি বলতে চেয়েছিলেন –

‘আমাকে তোমরা নিয়ো না কবরে
থেকে যেতে চাই আমি প্রতিদিনের খবরে’।

জীবন যেমন সত্য, মৃত্যু তেমন শাশ্বত। জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে পরাজিত হয়ে আব্দুল জব্বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন ঠিকই। বাংলা গানের আকাশে তিনি মহাতারকার মত জ্বলবেন অনন্তকাল ধরে, যার দ্যুতি কোনদিন নিভভে না। এখনো আমি শুনতে পাই তিনি যেন আমাকে গান লিখতে বলছেন। তাঁর জন্য আমার আর গান লেখা হয়না। ক্লান্তিতে, কষ্টে, বেদনায় ভিজে আমার গানের খাতা হয়ে যায় অনবদ্য ‘এক নীল দরিয়া’।

Add comment

সংস্কৃতি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.