আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

চক্রবর্তী এন্ড সন্স
চক্রবর্তী এন্ড সন্স

সেই সময়ের নদীয়া এবং এখনকার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি সর্ব কালেই এক অভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধারার পরিচয়ে পরিচিত। রাজনীতি থেকে সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক বিন্যাস থেকে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অর্থনৈতিক স্তর যেন সব কিছুতেই অন্যসব এলাকার সাথে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য ছিল। কুমারখালিতে জল যোগাযোগের সহজ মাধ্যম ছিল। এক সময়ের গৌড় বা এখনকার গড়াই নদীর তীর ঘেষা, আবার পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়াতে এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে তেমন চেষ্টা করতে হয় নাই। ১৮৫৭ সালে কুমারখালি প্রথম মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

তখন বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও বলিয়াকান্দি, কুষ্টিয়ার খোকসা, তদানিন্তন সময়ের কুমারখালির বর্তমানে বিলুপ্ত ভালুকা থানা, ঐ কুমারখালি মহকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিল। তখনকার সময়ে এখানে একটি মুন্সেফ আদালত স্থাপিত হয়। যে আদালতের প্রথম মুন্সেফ ছিলেন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সার্থক গ্রন্থকারিক সি আর দত্তের পিতা শ্রী ঈশান চন্দ্র দত্ত। ১৮৬১ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা স্থাপিত হলে কুমারখালি মহকুমার অস্তিত্ব হরণ হয়। সাধ্যকথা হলো ১৮৬০ সালে খোদ কলকাতার সাথে এখানকার রেলযোগাযোগ স্থাপন, সামগ্রিক ব্যবসায়িক গতিধারাকে আরো বেগবান করে দিয়েছিল। তবে সব সময়ই কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রশাসনিক,রাজনৈতিক, বাণিজ্য,অর্থনৈতিক যে বিষয়েই বলি না কেন, যুগের ধারায় তা ছিল কুমারখালির প্রভাবে আবৃত।

শ ম শওকত আলী তাঁর ‘‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’’ গ্রন্থে বলেছেন ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ সময় পর হতে কুমারখালিতে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটেছিল তা বাংলার আর কোন মফস্বল শহরে হয় নাই। আবার কুমারখালির রেশম ও নীল চাষের ইতিহাস খুবই পুরনো। এখানে সেই আদিকাল হতে পতঙ্গ নামে এক রকম সুতা দিয়ে তসর নামে কাপড় বুনন করা হতো। এখানে সাপ্তাহিক কাপড়ের হাট ছিল, যেটা এই বঙ্গের মধ্যে বেশ বড় ও প্রসিদ্ধ কাপড়ের হাট। ঐ সময়ের এই কাপড়ের হাটে বেঁচা-কেনা হতো লাখ লাখ টাকার সুতো, কাপড়, রং ও তাঁত সরঞ্জাম। ব্যাবসা-বাণিজ্যকে ঘিরে এখানে গড়ে ওঠে বসতি এবং বণিক শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ে এক সমাজ ব্যবস্থা তথা এক সভ্যতার প্রেক্ষিত স্তর। সমাবেশ হতে থাকে সাহা, কুণ্ডু, বণিক শ্রেণীর মানুষ এবং নীল করদের সমাগম ঘটার সাথে সাথে যোগ হতে থাকে ব্যবসায়িক মনষ্ক অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের।

১৮৩৮ সালের ৬ জুলাই ( বাংলা ১২৪৫ সালের ২১ আষাঢ়) ভারতখ্যাত কুষ্টিয়ার কুমারখালির সর্বসেরা কৃতি সন্তান স্বদেশী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক, বিখ্যাত মোহিনী মিলের জন্মরাজ মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এলঙ্গী পাড়ায় এক পরিশুদ্ধ ব্রাম্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তদীয় সময়ের বঙ্গীয় পুলিশ বিভাগের একজন কর্মচারী কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী ছিলেন এই গর্বিত সন্তানের পিতা। কুমারখালি শহরের নিকটবর্তী মুড়াগাছার রামানন্দ ভৌমিক মহাশয়ের দুহিতা ভগবতী দেবী ছিলেন মোহিনী চক্রবর্তীর গরীয়সী মাতা। পিতামহ নব কিশোর চক্রবর্তীও ছিলেন তদানিন্তন সময়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন কুমারখালি রেশম কুঠিরের বিশ্বস্ত দেওয়ান। মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর পিতৃ ও মাতৃকূল উভয়েই ছিলেন অর্থ ও বিত্ত প্রভাবিত এবং যুগের ধারায় প্রাচ্য আদর্শের অনুভাবনীয় অথচ ধর্মনিষ্ঠাবান ও ব্রাম্মণ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী। ৫ ভাই এবং এক মাত্র বোনের মধ্যে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন সকলের বড়। যখন তিনি ২২ বছরের যুবক তখন তার পিতা এবং যখন তার বয়স ২৭ তখন তার মা দিব্যধামে চলে যান। উদ্বিগ্ন, বিচলিত,হতবিহ্বল মোহিনী মোহন নিজের পরিবারের বিশাল বহরের সাথে সাথে কতকগুলো বিধবা বিপন্না আর্ত্তের ভরণ পোষন, দায়িত্ব গ্রহণ করে এগিয়ে চললেন। যেন কোন রোগশোক কিংবা কোন দু:খ-কষ্টই তাঁকে পেছনে নিতে পারে নাই। একদিকে পরিবারের ভার, অন্যদিকে সমাজের দায়িত্ব, এরই মধ্যে নিজেকে তৈরী করতে চলছে তার লেখাপড়ার সৌধ সাধনা।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছাত্র জীবনে কোথাও কখনও দ্বিতীয় ছিলেন না। তদানিন্তন সময়ে তিনি জুনিয়র এবং সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান গ্রহণ করে বিদ্বৎ সমাজে নিজেকে সার্থকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। লেখা পড়ার দৌড়ে তিনি খুব ভাল ফলাফল নিয়ে এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন। যেখানেই তার পড়াশোনা হোক না কেন তিনি ০১/১২/১৮৫২ তারিখ হতে ৩০/০৬/১৮৫৭ তারিখ পর্যন্ত ভারতের বর্ধমান (সম্ভবত) জেলার দি বোয়ালিয়াহ্ সরকারী বিদ্যালয়ে সাড়ে চার বছর জ্যামিতি, বীজ গণিত, পাটি গণিত, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এখানে তিনি স্মরণযোগ্য ফলাফল করেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৩/১৮৫৮ স্বারকে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হুররো গোবিন্দ সেন স্বাক্ষরীত স্কুলের এক সনদ পত্রে । তবে একথা সত্য, তিনি যে পরিমাণ বিদ্যার্জন করেছিলেন তা তদীয় সমাজে ছিল অতি গ্রহণযোগ্য- এ কথার সত্যতা মেলে।

যা হোক কর্মজীবনে তিনি নিজের অর্জিত জ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় কাল বিলম্ব না করে মাসিক ১৮ টাকা বেতনে কুষ্টিয়া মহকুমা অফিসে কেরানীর চাকুরী গ্রহণ করেন। চাকুরী গ্রহনের পর অফিসে মোহিনী মোহনের দক্ষতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সহনশীলতা দিন দিন ভাস্বর হয়ে উঠতে লাগল। কর্তা ব্যক্তিদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আর উপলদ্ধিতা ক্রমশ: বাড়তে লাগলো। মোহিনী চক্রবর্তীর কাজের প্রশংসায় তাঁর উর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে কুষ্টিয়া মহকুমার তৎসময়ের সাবডিভিশনাল ম্যাজিষ্ট্রেট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি এবং বাংলার সর্বময় কর্তা বঙ্গীয় লেফপ্ট্যানেন্ট গভর্ণর স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাদের চাকুরীর বদলীজনিত সময়ে মোহিনী চক্রবর্তীর গুণমুগ্ধতার পুরস্কার স্বরূপ প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম পরে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে সন্মানীত ও উপযুক্ত পদে পদায়ন করে যান। এখান থেকে মোহিনী বাবুর জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করে। এই দুই মহানুভবতার দয়া, আশির্বাদ আর উৎসাহে তিনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পদে পরীক্ষার জন্য তৈরী হলেন। তিনি সে পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়ে বিচারকের আসন বাগিয়ে নিতে সামর্থ হন।

ম্যাজিষ্ট্রেট মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। এখানেও রয়েছে তাঁর কর্মজীবনের ব্যাপক উত্থান, আবার পতনের ঘটনার ঘনঘটা। তখন তিনি নোয়াখালীর ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত দুজনের একজন সেরেস্তাদার এবং অন্যজন কর্মচারী ছিলেন। এই ঘটনার বিচারের ভার বর্তায় আমাদের মোহিনী বাবুর উপর। কালেক্টর সাহেব আগেই তাকে অভিযুক্ত দুজনকে শাস্তি প্রদানের জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা ও ন্যায়নিষ্ট বিচারক মোহিনী বাবু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের মুক্তি দেন। এতে মোহিনী বাবুকে কালেক্টর সাহেবের বিরাগ ভাজন এবং রোষাণলে পড়তে হয়েছিল বটে কিন্তু মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এতটুকুও নিজেকে দূর্বল কিংবা অবনমিত হন নাই। যে জন্য তাঁকে তার বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি এবং জেলার ভারপ্রাপ্ত কালেক্টর হওয়ার সুযোগ হতে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তিনি যতটা ধর্মপরায়ন ছিলেন ঠিক ততটাই ছিলেন ন্যায় পরায়ণ এবং অসাম্প্রদায়িক। আরেকটা ঘটনা মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর বিচারিক জীবনে রেখাপাত ঘটিয়েছিল। তিনি কোন এক গুরুতর আসামীদের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে উপযুক্ত স্বাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন নাই। কেননা এতে তার বিবেক দংশিত হতে পারতো বলে ন্যায় বিচারে আসামীদেরকে মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন। বিষয়টি সর্বত্র চড়াও হলে কমিশনার মহোদয় কোন নোটিশ ছাড়াই মোহিনী বাবুর অফিস পরিদর্শনে এসে তার বিচারের বিষয় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে উদ্যত হতেই মোহিনী বাবু আদালতে বসে নির্ভিক চিত্তে উত্তেজক মন্তব্য করেন ‘‘Do you think Mr…….I have sold my conscience for money ?’’ তার এমনও বিচার বৈশিষ্ট্য ও কর্ত্তব্য বুদ্ধির জন্য তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান বিচারক।

আরেকবার আমাদের বিচারক বাবু তখন ভাবুয়া ( পশ্চিম বঙ্গ, ভারত) মহকুমাতে নিয়োজিত ছিলেন। ঐ সময়ে বাবুর জেষ্ঠ্য পুত্র এক বন্ধুসহ এখানে এসেছিলেন। হঠাৎ বন্ধুকে নিয়ে ছেলে এক বুদ্ধি আটলেন। বাবুর পরিচয় ও প্রভাবকে পূঁজি করে এক ব্যক্তির পুকুর হতে তারা মাছ শিকার করে আনলো। কান থেকে কানে এই কথা পৌঁছুল বাবু পর্যন্ত। বিচার বিধাতা নিজ উদ্যোগে পুকুর মালিককে ডাকলেন। পুত্র ও তার বন্ধুকে মুখোমুখি করে বললেন ‘এরা আপনার পুকুর হতে মাছ ধরে বড়ই গর্হিত কাজ করেছে। এদের বিরুদ্ধে আপনি থানা অথবা আদালতে নালিশ করুন। এদের অপরাধের সমুচিত বিচারের ব্যবস্থা করুন।’’ সততা আর এই অমিয়তার জন্য তিনি ছিলেন সব সময়ে, সকলের কাছে আদৃত ও সমোহিত। তিনি অদ্যবধি আমাদের কাছে যুগের ধারায় যে কারনে অমরগাথা তা বলতে গেলে সেক্সপিয়ারের একটি কথা বলতে হয়। যেটা তিনিই প্রায়শ: বলতেন, তা হলো ‘‘I am armed so strong in honesty’’……..``Flattery is the food of fools’’ মোহিনী মোহন চক্রবর্তী বেশ কিছুদিন ভাগলপুরে ( পশ্চিম বঙ্গ, ভারত) জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে চাকুরী করেছেন।

মোহিনী মোহনের শিল্প সৃষ্টির কল্প ভাবণাঃ-

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী বাল্যে পিতা-মাতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন আদর্শগত এক জীবন পাঁচালির অনুসঙ্ঘ। সরকারী চাকরী হতে অবসর নেয়া হলো। বাল্যের আদর্শ। কৈশোরের পরিপূর্ণ মেধা। যৌবনের কর্মশক্তি। দিন দিন হৃদয়ে এমন এক বীজ উপ্ত হতে লাগল যে তাঁর স্বদেশের প্রতি মায়া এবং হিতৈষির আকাঙ্খা বাড়তে লাগল। অবসর সময় পার করতে কুষ্টিয়া শহরের বর্তমান জায়গায় বিশ্রাম নিতে নিতে মা-মাটি আর মানুষের প্রতি কর্তব্যের শেকড় বিস্তৃতির কর্মসাধনায় তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। মনের মধ্যে তখন দেশের শিল্প বিকাশের প্রয়োজনীয়তা থেকে স্বদেশী অনুরাগের প্রতি দূর্বল্য প্রভাব দিন দিন প্রভাবিত করতে লাগল। পণ্য স্বদেশী, তা যতই হোক না কেন নগন্য। আর বিদেশী পণ্য নয়।

১৯০৭ সাল। মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ‘চক্রবর্তী এন্ড সন্স’ নামে এক কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৮ সাল মাত্র ০৮ খানা তাঁত নিয়ে ‘মোহিনী মিলস্ লিঃ’ নামে এক বস্ত্র কলের যাত্রা শুরু করেন। যে কলের মোটা শাড়ী ও ধূতি বাংলার ঘরে ঘরে এক পবিত্র সম্ভার হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। পরে তিনি কুষ্টিয়া ছাড়াও নদীয়া জেলার বেলঘড়িয়াতে দুই নম্বর মোহিনী মিলস্ গড়ে তোলেন। তবে একথা সত্য এই মিল প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলার মানুষের মধ্যে বিশাল এক আগ্রহ জাগ্রত হয়েছিল। বাংলাতে তখন কোন বস্ত্র কল ছিল না। সমগ্র ভারতের মানুষের লজ্জা নিবারণে তখন নির্ভর করতে হতো ল্যাঙ্কাশায়ারের উপর। ভারতের বস্ত্র সামগ্রির দাম নির্ধারণ করতো এই ব্যাক্তিই। মোহিনী বাবু এই বস্ত্র কল পরিচালনার জন্য তার দুই পুত্র কে বোম্বে পাঠিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়ে আনেন। দিন দিন যখন মিলের উৎপাদন ও বিপনন এগিয়ে যেতে লাগল, তখন সর্ব সাধারণেরা মোহিনী বাবুকে এই বস্ত্র কলটিকে সাধারণের জন্য গড়ে তুলতে অনুরোধ জানাতে থাকেন। যে কারনে তিনি সাধারণের অনুরোধের প্রতি সদয় হয়ে ১৯০৮ সালে এই মিলটিকে লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত করেন। এখানে যোগদান করে অনেক বাঙালি সন্তানেরা তাঁদের অন্নের সংস্থান করতে থাকেন।

কোন দায়গ্রস্থ ব্যাক্তি মোহিনী বাবুর নিকটে এসে খালি হাতে ফিরেছেন, এমন নজির ছিল না। তিনি দান ধ্যানের কারনে ছিলেন আর্ত্তের সুহৃদ ও বন্ধু। তিনি তখন আরায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তাঁর এক গৃহভূত্য ছিলেন। তাঁর নাম মাতারাম কাহার। এই ভূত্য দূরারোগ্য ও সংক্রামক ‘বিসূচীকা’ রোগে আক্রান্ত হলে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাড়িতে রেখে ঐ ভুত্যের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। নিজে এবং পুত্রকে নিয়োজিত করে অনেক চেষ্টা করেও মাতারামকে বাঁচানো গেল না। মাতারাম তাঁর মৃত্যুর আগে নিজের ব্যবহূত সুবর্ণ তাবিজ খুলে মোহিনী বাবুর হাতে অর্পণ করেছিলেন। মোহিনী বাবু এই মৃত্যুতে বেশ বিচলিত হলেন বটে। তবে হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান বারাণসীতে গিয়ে তিনি ব্রাম্মণদের দিয়ে বেদ পাঠ করিয়ে ঐ সুবর্ণ তাবিজ ব্রাম্মণদের হাতে অর্পণ করেছিলেন। যেটা ছিল মাতারাম কাহারোর শেষ ইচ্ছে।

পড়াশোনা ছিল মোহিনী বাবুর নিত্য দিনের রুটিন কাজের এক অংশ। সংবাদপত্র ও বই পড়া ছিল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। গভীর রাত্রি পর্যন্ত পাঠ অভ্যাস ছিল তাঁর। বাড়িতে একটি পুস্তকালয় ছিল বেশ সুসজ্জিত ও মনোরম দর্শনের। তিনি কোন নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। মদ-ত দূরের কথা কোন চুরুট কিংবা পান বা তামাক জাতীয় কোন দ্রব্যও তাঁকে কোন দিন স্পর্শ করতে পারে নাই।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ব্যাক্তি। পড়াশোনা করা এবং করতে সাহায্য করাই তার ছিল প্রগাঢ় উদারতা। ১৮৭১ সাল মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ছিলেন ফরিদপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট। এখানে তিনি পরবর্তিতে সময়ে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটও হয়েছিলেন। ঐ সময়ে কুমারখালির ্ঐতিহাসিক ও কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ভাব শিষ্য জলধর সেনের পিতৃ বিয়োগ ঘটে। জলধর সেন তার ভাই ও বিধবা মাকে নিয়ে অসহায় হয়ে পরেন। শরিকরা তাদেরকে কোন সহায়তা না দিয়ে প্রকারান্তে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তার জেঠতুতো দাদা ঐ সময়ে গোয়ালন্দ মহকুমা আদালতের পেশকার ছিলেন। তিনি জলধর সেনদেরকে গোয়ালন্দে এনে জলধর ও ভাই হলধর সেনকে গোয়ালন্দ মইনর স্কুলে ভর্ত্তি করিয়ে দেন। জলধর সেন এখানে ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি এ সময়ে পরীক্ষায় বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মধ্যে বেস্ট রেজাল্ট করে ‘রাজা সূর্য কুমার’ প্রবর্তিত রৌপ্য পদক লাভ করেন।

বিষয়টি ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জানলেন এবং এও জানলেন জরধর সেন তার জন্ম ভূমি কুমারখালির সন্তান। যে কিনা রেজাল্ট ভাল করে এলাকারও মুখ উজ্জল করেছে। পরে জলধর সেনকে ফরিদপুরে এনে জেলা স্কুলে ভর্ত্তি করিয়ে দেন।তবে এই স্কুলে জলধর ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলেন মাত্র (সূত্র : বাবু মল্লিক, সভাপতি, রাজবাড়ী প্রেস ক্লাব)। শ্রমিকেরা শুধু কাজ করে ঘাম ঝরাবে তা কি হয় ? মোহিনী বাবু ১৯৩০ সালে মোহিনী মিলের কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য মিলপাড়াতে গড়ে তোলেন ‘সান্ধ্য সমিতি’ নামে একটি থিয়েটার এবং তাদের সংবাদপত্র ও বই পড়ার জন্য লাইব্রেরী। তদানিন্তন সময়ে মোহিনী মিলের ফুটবল টিম ছিল কলকাতা দলের সাথে টক্কর দেওয়ার মত পারদর্শি।

মোহিনী মোহন চক্রবর্তী নিয়মিত ধর্মীয় রীতি মেনে চলতেন। তিনি ধর্মীয় আচার সম্পন্ন করে আহার করতেন। সে আহার ছিল পরিমিত, তা যতই লোভণীয় খাবার হোক না কেন। তিনি চাকুরী হতে অবসর নেয়ার পরেও ২৭ বছর পেনশন ভোগ করেছিলেন। তিনি নিরোগ অবস্থায় ৮৪ বছর ৪ মাস বয়সে ১৯২২ সালের ০৪ নভেম্বর (বাংলা ১৩২৮সালের ২০ কার্ত্তিক) তারিখে বয়সের প্রাকৃতিক ধারায় দিব্যধাম গমন করেন। যে প্রস্থান ছিল কালের প্রবাহে যুগ সৃষ্টি ধারায় এক অর্থমুক্তির অজবীথি ও বিচার বিধাতার নি:শব্দ প্রস্থান।

ঋণ স্বীকারঃ- বাবু সুনীল কুমার বাগচী, গাজনা,মধুখালি, ফরিদপুর।

গৌতম কুমার রায়
গবেষক, উদ্ভাবক (জৈব বালাই নাশক),
পরিবেশ ব্যাক্তিত্ব ও পদক বিজয়ী প্রাবন্ধিক।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.