আপনাকে কুষ্টিয়াশহর.কম এর পক্ষ হতে ঈদ মোবারক 🌙। বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

বাউল - সাইমন জাকারিয়া
বাউল - সাইমন জাকারিয়া

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ সৃজনশীল সাধকদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই সম্প্রদায় মূলত দেহ-সাধনা করেন এবং গানের মাধ্যমেই সেই দেহ-সাধনার কথা প্রকাশ ও প্রচার করেন। বাউলদের রচিত গানের ভাবের গভীরতা, সুরের মাধুর্য, বাণীর সার্বজনীন মানবিক আবেদন বিশ্ববাসীকে মহামিলনের মন্ত্রে আহ্বান করে।

তাই ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাংলার বাউলগানকে দি রিপ্রেজেন্টিটিভ অব দি ইন্টানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য তার আগেই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশক হতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলগান ও বাউলদের সাধনপদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পাশাপাশি বাংলার বাউলগান পরিবেশন করতে গ্রামের বাউল সাধকশিল্পীগণ নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তবে, জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পরিমহলে বাউলদের সাধনা ও গান সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবীর তৎপরতায়, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বাউল ও বাউল সম্পর্কে বিশেষভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এমনকি নিজের রচনার ভাবসম্পদ হিসেবে বাউলগানের ভাবাদর্শ তিনি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর গৃহীত হয়েছিল বাউল গগন হরকার গান হতে।

বাউল সাধনার ইতিহাস ও সাধন-পদ্ধতি: দেহকেন্দ্রিক বাউল-সাধনার সাথে প্রাচীন ভারতীয় সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে, বাউল-সাধনা মূলত বৈদিক বা ব্রাহ্মণ আচার বিরোধী এবং মৈথুনাত্মক ও রাগানুগা সাধনার পক্ষপাতী। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ও নাথধর্মের দেহ-সাধনার সাথে বাউল-সাধনার নৈকট্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাহিত্য-সংস্কৃতির নিদর্শন আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত চর্যাগীতির অনেক পদের সাথে বাংলার বাউলদের দেহ-সাধনার প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়। যেমন- চর্যার প্রথম পদেই লুইপা যে দেহ সাধনার কথা বলেছেন, তা হলো- ‘কাআ তরু বর পঞ্চ বি ডাল।/চঞ্চল চিএ পৈঠ কাল॥/দৃঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।/লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান॥’ অর্থাৎ মানবদেহে বৃক্ষশাখার মতো পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, আর তাদের চব্জলতার জন্য মৃত্যু ধেয়ে আসে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মহাসুখের দেখা মেলে। লুই বলেন- গুরুর কাছ থেকেই কেবল সেই দেহ-সাধনায় মহাসুখ পাবার কৌশল জানা যায়। এ ধরনের কথার ভেতর দিয়ে দেহ-সাধনার জন্য যে গুরু আবশ্যক সেই নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলার বাউলরা আজও দেহ-সাধনার জন্য চর্যায় বর্ণিত সেই গুরুকেই আশ্রয় করে থাকেন। কিন্তু বাউল-সাধনার পূর্ণাঙ্গ উদ্ভব ও বিকাশ কাল হিসেবে সাধারণত ১৪৮৬ হতে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান চৈতন্যদেবের সময়কে শনাক্ত করা হয়। কথিত আছে যে, চৈতন্যদেবের মৈথুনাত্মক সাধন-পদ্ধতি অনুসরণে আউল চাঁদের শিষ্য মাধববিধি বাউলমত প্রবর্তন করেন এবং মাধববিবির শিষ্য বীরভদ্রের তৎপরতায় এই মতের বিস্তৃতি ঘটে। বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন,

“যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল আর যে-সব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু-সমাজ ভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উল্টরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।”

বাউল সাধনার সাথে যেহেতু নানা ধর্মমতের প্রভাব রয়েছে সেহেতু বাউল গানে হিন্দু প্রভাবে রাধা-কৃষ্ণ, শিব-শিবানী, মায়া-ব্রহ্ম, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি পুরুষ-প্রকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, মুসলিম প্রভাবে তেমনি মোকাম, মঞ্জিল, লতিফা, সিরাজম্মুনিরা, আল্লাহ, কাদের, গনি, রসুল, রুহ, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহম্মদ-খাদিজা, আলি-ফাতেমা প্রভৃতি প্রতীকী রূপক গৃহীত হয়েছে। আবার বৌদ্ধ নাথ এবং নিরঞ্জনও পরিত্যক্ত হয়নি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৌরাণিক উপমা ও কুরআন-হাদিসের বাণীর নানা ইঙ্গিত [যেমন বর্জখ]। অবশ্য বাউল রচনায় এসব শব্দ ও পরিভাষা তাদের মতানুগ অর্থান্তর তথা নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। বৈষ্ণব ও সূফী সাধনার সঙ্গে বাউল মতের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি পরিহার করে যে মিলন-ময়দান তারা তৈরি করল, তাকে সার্থক ও স্থায়ী করার জন্য পরমাত্মা বা উপাস্যের নামেও এক সর্বজনীন পরিভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। তাদের ভাষায় ‘পরমতত্ত্ব’ পরমেশ্বর বা সচ্চিদানন্দ হচ্ছেন মানুষ, অটল মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সাঁই, অচিন পাখি, মনুরা প্রভৃতি পরমাত্মা- আত্মারই পূর্ণাঙ্গ রূপ। বাউল মতে, দেহস্থিত আত্মাকে কিংবা আত্মা সম্বলিত নরদেহকে যখন ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করা হয়, তখন পূর্ণাঙ্গ বা অখ- আত্মা বা পরমাত্মাকে মানুষ বলতে বাধা থাকে না। বাউল সাধনার এই প্রকৃতি বিচারে ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় সতেরো শতকের মধ্যভাগ হতে বাউল মতের উদ্ভব। গুরু, মৈথুন ও যোগ তিনটিই সমগুরুত্ব পেয়েছে বাউল মতে। তাই গুরু, বিন্দুধারণ ও দম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা বাউল গানে অত্যাধিক। সৎগুরুর কাছে দীক্ষা না নিলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা অসম্ভব এবং বিন্দুধারণে সামর্থ্যই সিদ্ধির প্রকৃষ্ট নিদর্শন। বাউল মতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। এই দেহস্থিত আত্মাই মানুষ, মানের মানুষ, রসের মানুষ, অলখ সাঁই। বাউলের ‘রসস্বরূপ’ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এটিই আত্মতত্ত্ব। এর মাধ্যমে অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া, স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ। সহজিয়াদের ‘সহজ’ই সহজ মানুষ। মৈথুন মাধ্যমে বিন্দুধারণ ও উর্ধ্বে সঞ্চালনের সময়ে গঙ্গা (ইড়া) ও যমুনা (পিঙ্গলা) বেয়ে সরস্বতীতে (সুষু¤œায়) ত্রিবেণঅ (মিলন) ঘটাতে হয়। তারপর সেখান থেকে সহ¯্রায় (মস্তকস্থিত-সহ¯্রদল পদ্মে) যখন বিন্দু গিয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি হয় মহাভাব বা সহজ অবস্থা। বাউলগণ মূলত সাধনায় সেই মহাভাব অর্জন করেন।

বাউলের শাব্দিক অর্থ ভেদ

বাংলার বাউল, বাউল মত ও বাউল সংগীত তথা বাউল গান নিয়ে নানা জনের নানা মত প্রচলিত। এই মতানৈক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “বাউল” শব্দটি। আসলে, “বাউল” শব্দটির অর্থ, তাৎপর্য, উৎপত্তি ইত্যাদি নিয়ে অদ্যাবধি গবেষকেরা যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি, তেমনি “বাউল মত”-এর স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করতে পারেন নি। নানা জনের নানা মত নিয়েই “বাউল মত” বিষয়ে অমীমাসিংত আলোচনা চলছে এবং চলমান থাকবে বলেই আমাদের ধারণা।

বাউল মত ও তার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কোনো কোনো গবেষক বলেছেন- সংস্কৃত “বায়ু” থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, তাঁদের মতে সংস্কৃত বায়ু= বাঙ্গালা “বাই”, “বাউ” শব্দের সাথে স্বার্থে “ল” প্রত্যয়যোগে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, এই মতানুসারি গবেষকদের ভাষ্যে জানা যায়- বাংলার যে সব লোক “বায়ু” অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করেন, তাঁরাই বাউল।

গবেষকদের কেউ কেউ আবার বলেছেন- সংস্কৃত “বাতুল” শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, প্রাকৃত ব্যাকরণ মতে- দুই স্বরবর্ণের (এখানে “আ” এবং “উ”) মধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ (এখানে “ত”) লোপ পায়, আসলে এঁই সূত্রমতেই “বাতুল” শব্দটি “বাউল” হয়ে গেছে, গবেষকদের মতে- যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তাঁরা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তাঁরাই বাউল। বাউল মতের স্বরূপ নির্ধারণের প্রশ্নে গবেষকদের অন্য দল বলেন- প্রাকৃত “বাউর” শব্দ হতে “বাউল” শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে, “বাউর” অর্থ এলো-মেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল। এই দলের গবেষক-মতে, বাংলার বাউলদের মতো একদল বিশৃঙ্খল চিন্তাজীবী লোক উত্তর-ভারতে প্রত্যক্ষ করা যায়, বাংলার বাউল চিন্তার দিক হতে তাদেরই এক গোষ্ঠীভুক্ত। সুতরাং উত্তর-ভারতীয় প্রাকৃত শব্দ “বাউর” বাংলাদেশে “বাউল” শব্দে পরিণত হয়ে থাকবে, কেননা লোকায়ত সমাজে উচ্চারণ-ধ্বনির দিক দিয়ে “র” এবং “ল” বর্ণের সাদৃশ্য থাকায় অনেক ক্ষেত্রে এই দুটি বর্ণ পরস্পরের রূপ গ্রহণ করে থাকে।

আরেক শ্রেণীর গবেষকদের ভাষ্যমতে- “বাউল” শব্দকে “আউল” শব্দের পৌনঃপুনিক অপভ্রংশ বলে মনে করেন, তবে তাঁরা এ কথা মনে করেন না যে “আউল” শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত “আকুল” শব্দ হতে, তার বদলে মুসলমান সাধক অর্থে আরবি “অলী” শব্দের বহুবচন “আউলিয়া” শব্দ হতে “ইয়া” প্রত্যয়ের পতনে উৎপত্তি বলে মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে- বাংলার যে সব লোক মুসলমান দরবেশদের মতো লম্বা আল্খেল্লা পরে, তাঁদের বাণী ও বিশ্বাসে আস্থাপরায়ণ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাঁরাই বাউল। এই জন্যই নাকি বাউল-সন্ন্যাসীদের “ফকির” বলা হয়।

গবেষক মুহম্মদ এনামুল হক “বাউল” শব্দের উৎপত্তি ও তার অর্থ সম্পর্কে উপর্যুক্ত নিষ্পত্তিগুলো উদ্ধৃতি দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, “বাউল সম্প্রদায়ের নাম বাউলেরা নিজে গ্রহণ করে নাই। সাধারণ বাউল-বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করিয়াই, দেশের লোক তাহাদিগকে এই নাম দিয়াছে।”

মুহম্মদ এনামুল হকের এই বক্তব্যের সাথে একথা যুক্ত করা অসঙ্গত হবে না যে, বাউলেরা নিজেরা যেহেতু নিজেদের বাউল নামটি দেন নি সেহেতু “বাউল” শব্দটির উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত রয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বাউল মতের মর্মকথা অনুধাবন করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.